
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে ২০২৫ সালের ঈদুল আজহা উপলক্ষে এবার দেশজুড়ে পশু কোরবানির সংখ্যা ৯১ লাখ ছাড়িয়েছে। সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোট কোরবানিকৃত পশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৪৮৪টি। এর মধ্যে গরু ও মহিষ মিলিয়ে ৪৭ লাখ ৫ হাজার ৫৭০টি এবং ছাগল ও ভেড়া মিলিয়ে কোরবানি হয়েছে ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৯৩টি।
মঙ্গলবার (১১ জুন) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এবারের ঈদে দেশে কোরবানির পশুর উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক বেশি ছিল। সেই কারণে বাজারে প্রায় ৩৩ লাখ ১০ হাজার পশু অবিক্রিত থেকে গেছে।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এসব অবিক্রিত পশু পরবর্তীতে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক আচার কিংবা পরবর্তী ঈদুল আজহা পর্যন্ত বিক্রির জন্য পালন করে রাখা হতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট অনেক খামারি এই অতিরিক্ত পশু অবিক্রিত থাকায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবারের ঈদুল আজহায় সর্বাধিক পশু কোরবানি হয়েছে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগে। এখানেই কোরবানিকৃত পশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৫টি, যা জাতীয় কোরবানির সংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ।
এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে—সংখ্যা ২১ লাখ ৮৫ হাজার ২৮৪টি। দেশের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় এই অঞ্চলে পশু চাহিদাও সর্বদা বেশি থাকে।
চট্টগ্রাম বিভাগে কোরবানিকৃত পশুর সংখ্যা ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ১২৮টি। রংপুর বিভাগের মতো অপেক্ষাকৃত পশু পালনে সমৃদ্ধ অঞ্চলেও কোরবানি হয়েছে ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৩৭৬টি।
খুলনা বিভাগে কোরবানির সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৪ হাজার ১৪৬টি। বরিশাল বিভাগে পশু কোরবানির সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার ১৩টি।
তবে সবচেয়ে কম কোরবানি হয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের দুই বিভাগে। ময়মনসিংহ বিভাগে কোরবানি হয়েছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭টি এবং সিলেট বিভাগে সর্বনিম্ন ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৪৬টি পশু কোরবানি হয়েছে।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এবছর স্থানীয় খামারিরা চাহিদার তুলনায় অধিক পশু উৎপাদন করেছেন। বিশেষত করোনা মহামারির পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে খামার খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে অনেক খামারি নিজেদের বিনিয়োগ নিরাপদ রাখতে এবার অধিক পশু লালন করেছেন।
তবে মাঠপর্যায়ের খামারিদের মতে, বাজারে চাহিদার চেয়ে পশুর সরবরাহ অনেক বেশি হওয়ায় অনেকেই কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি। কেউ কেউ পশু বিক্রি না করেই বাড়ি ফিরেছেন, আবার কেউ কম দামে বিক্রি করে লোকসান গুনেছেন।
বিশেষ করে সীমিত আকারে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে চোরাই পশু প্রবেশের অভিযোগ এবং বড় শহরগুলোতে অনলাইনে পশু কেনাবেচার প্রসারও স্থানীয় খামারিদের বিক্রি ব্যাহত করেছে বলে দাবি উঠেছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কোরবানির মৌসুমে পশু স্বাস্থ্য সেবা এবং নিরাপদ বাজার ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে তারা সারাদেশে ১০ হাজারের বেশি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম মোতায়েন করেছিল। এছাড়া অনলাইন হাট, ভ্রাম্যমাণ পশুর বাজার, স্বাস্থ্য সনদ, পশু ওজনের ডিজিটাল সেবা ইত্যাদি চালু করে সরকার কোরবানির পুরো প্রক্রিয়া নিরাপদ ও স্বচ্ছ রাখতে চেয়েছে।
সরকারের দাবি, এবারের কোরবানির মৌসুমে কোনো ধরনের বড় অস্বাভাবিকতা বা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়নি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন বাজার মনিটরিংয়ে সক্রিয় ছিল।
৯১ লাখের বেশি পশু কোরবানির এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঈদুল আজহা উদযাপনের ধর্মীয় অনুশীলন ও অর্থনৈতিক প্রবণতা উভয়েরই বহিঃপ্রকাশ। তবে একইসঙ্গে এটি বাজার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যের অভাব এবং পশু খাতের নীতিগত দিকনির্দেশনার সংকটও তুলে ধরেছে।
অতিরিক্ত পশু উৎপাদন এবং অবিক্রিত পশুর বিপুল সংখ্যা আগামীতে খামারিদের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে এবং কোরবানির পশুর সরবরাহ-চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য আনতে প্রয়োজন সময়োপযোগী নীতিমালা, বাজার পূর্বাভাস এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা। একইসঙ্গে স্থানীয় খামারিদের টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা ও বাজার সুরক্ষা ব্যবস্থাও জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ