
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফররত। এই সফরের মধ্যেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য এবং সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিক তার সঙ্গে একটি বৈঠকের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠান বলে দাবি করেছে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। যদিও ড. ইউনূসের দফতর বলছে, তার কাছে টিউলিপের কোনো চিঠিই পৌঁছেনি, ফলে সাক্ষাতের সুযোগও তৈরি হয়নি। বিষয়টি এখন নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে দুই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বলছে, চিঠি পৌঁছায়নি
রোববার (৮ জুন) ঢাকায় ড. ইউনূসের কার্যালয়ের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, "টিউলিপ সিদ্দিকের কোনো চিঠি পাননি প্রধান উপদেষ্টা। ৫ জুন থেকে আমরা ছুটিতে আছি। ফলে ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর চলাকালে এ ধরনের কোনো সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়নি।"
এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, টিউলিপের বহু কাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। যদিও চিঠি প্রেরণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে এবং তা ঘিরে বাংলাদেশি রাজনীতিতে নানা জল্পনা-কল্পনা ছড়িয়েছে।
গার্ডিয়ানের দাবি: টিউলিপ সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে দাবি করে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক সম্প্রতি ড. ইউনূসের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তার এবং তার মায়ের বিরুদ্ধে উদ্ভূত ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসনের লক্ষ্যে একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, টিউলিপ এই সাক্ষাতের মাধ্যমে ড. ইউনূসের কাছে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে চান এবং তার পারিবারিক পরিচয় ও রাজনৈতিক সংযোগের কারণে তাকে লক্ষ্য করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে কথোপকথনা করতে চান।
চিঠিতে টিউলিপ লেখেন, "আমি আশা করি, সম্ভাব্য এই বৈঠক ঢাকার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কিছু ভুল বোঝাবুঝির নিরসনে সহায়ক হবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমার মায়ের বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে, কিন্তু আমি একজন স্বাধীন রাজনীতিবিদ। যুক্তরাজ্যে জন্মেছি, বড় হয়েছি এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছি। বাংলাদেশে আমার কোনো আর্থিক স্বার্থ নেই। দেশটি আমার হৃদয়ে থাকলেও সেটি আমার দেশ নয়। আমার দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য—যেখানে আমি আমার কর্মজীবন গড়ে তুলেছি।"
দুর্নীতির অভিযোগ: টিউলিপ ও তার মাকে জড়িয়ে দুদকের তদন্ত
উল্লেখ্য, টিউলিপ সিদ্দিক ও তার মা শেখ রেহেনার বিরুদ্ধে সম্প্রতি বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিক অভিযোগ এনেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ—রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ৭ হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের একটি প্লট দখলে নেওয়া। দুদকের ভাষ্যমতে, এটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার।
তবে টিউলিপ এসব অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন। তার আইনজীবীরা বলছেন, "এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশপ্রণোদিত। এটি একটি ভিন্নমতাবলম্বী পরিবারকে টার্গেট করার কৌশলমাত্র। অভিযোগের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।"
টিউলিপ দাবি করেছেন, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ কখনো তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেনি। ফলে তিনি কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগই পাননি।
যুক্তরাজ্যে তার অবস্থান ও পদত্যাগ
টিউলিপ সিদ্দিক ২০১৫ সাল থেকে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও হাউগেট আসন থেকে লেবার পার্টির সংসদ সদস্য। যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ে তিনি ‘সিটি মিনিস্টার’ পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ২০২3 সালের শেষদিকে তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ তদন্ত বা মূল্যায়নে তার বিরুদ্ধে আনীত কোনো দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। ফলে দেশটির রাজনীতিতে তার ভাবমূর্তি এখনও পরিষ্কার।
সাক্ষাৎ না হওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি
এই চিঠি এবং তার জবাবহীনতা ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতি প্রবাসী রাজনীতিকদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? এবং এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সংলাপ ও সমঝোতার সম্ভাবনা কতটা বাস্তব?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনায় আগ্রহী নয়, বিশেষ করে যদি সেই ব্যক্তি কোনোভাবে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য হন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ