
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস এবং আন্তর্জাতিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও কার্গো সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মেনজিস এভিয়েশন। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল খাতকে আধুনিকায়ন ও প্রসারিত করতে সরকারকে যৌথভাবে এবং পৃথকভাবে সহযোগিতা করতে চায়।
গত মঙ্গলবার (১০ জুন) যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এসব প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পৃথক দুই বৈঠকে অংশ নেয় এয়ারবাস এবং মেনজিসের শীর্ষ নির্বাহীরা।
প্রথম বৈঠকে অংশ নেন এয়ারবাসের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়াউটার ভ্যান ভার্শ, যিনি সরাসরি ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। একই দিন আরেকটি বৈঠকে অংশ নেন মেনজিস অ্যাভিয়েশনের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট চার্লস ওয়াইলি।
এয়ারবাসের শীর্ষ কর্মকর্তা ভ্যান ভার্শ বৈঠকে বলেন, “বাংলাদেশ আমাদের কাছে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ। আমরা বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে সরাসরি অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চাই। আমাদের লক্ষ্য হলো এই প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনকভাবে পরিচালনায় সহায়তা করা।”
তিনি জানান, এয়ারবাস শুধু বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমানই নয়, বরং হেলিকপ্টার, সামরিক যুদ্ধবিমান এবং মহাকাশযান তৈরিরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর গড়ে ৮০০টির বেশি বিমান সরবরাহ করে তারা, যার মধ্যে বেশিরভাগই বিশ্বের প্রধান বিমান সংস্থাগুলোর বহরে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশের সরকারি পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমানের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভ্যান ভার্শ বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ বিমানের বহর আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি দিয়ে বিমানের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়াতে পারি।”
বিশ্বজুড়ে এয়ারবাসের সফল অংশীদারিত্বের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি জানান, যদি বাংলাদেশ সরকার এয়ারবাসের বিমান যুক্ত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বিমান ক্রয়ের মোট অর্থের ৮৫ শতাংশই ‘এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি (ECA)’ অর্থায়নের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। এ ধরনের অর্থায়ন মূলত দীর্ঘমেয়াদী এবং তুলনামূলকভাবে সহজ শর্তে দেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে প্রস্তাবগুলো শোনেন এবং বলেন, “আমরা আগ্রহ সহকারে আপনাদের প্রস্তাব শুনছি। তবে কোনো কিছুই আমরা তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেব না। আমরা চাই, সমস্ত দিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। বিমান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনাদের পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা আমাদের ভাবনায় জায়গা করে নিচ্ছে।”
অপর বৈঠকে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিমানসেবা প্রতিষ্ঠান মেনজিস এভিয়েশন জানায়, তারা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও এয়ার কার্গো সেবা দিতে আগ্রহী। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তারা ইতোমধ্যে ৬৫টি দেশের ৩০০টির বেশি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একই ধরনের সেবা দিয়ে আসছে এবং বাংলাদেশেও এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায়।
মেনজিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট চার্লস ওয়াইলি বলেন, “আমরা কেবলমাত্র জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থাকে সহায়তা করতে চাই না, বরং দেশের বিমানবন্দরগুলোকেও একটি আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে প্রস্তুত। আমরা একটি প্রমাণিত ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান এবং যেকোনো ধরনের প্রযুক্তি ও সেবাদান সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, একটি আধুনিক ও কার্যকর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা ছাড়া কোনো বিমানবন্দর সম্পূর্ণ হতে পারে না। তৃতীয় টার্মিনালের মাধ্যমে বাংলাদেশের আকাশপথে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা অংশ নিতে আগ্রহী।”
এয়ারবাস ও মেনজিসের এই আগ্রহ বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিমান খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ বিমানের বহর পুরোনো হয়ে পড়ছে এবং আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তখন আধুনিক বিমান সংযোজন ও উন্নত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এ ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে সব দিক বিবেচনা করতে চাচ্ছে, সেটিকে পরিণত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য বলেই মনে করছেন অনেকে। বিভিন্ন মহল থেকে মত এসেছে যে, এয়ারবাস বা মেনজিসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশীদার হিসেবে নিলে বাংলাদেশ শুধু বিমানবন্দর ও এয়ারলাইন্স খাতে উন্নয়নই পাবে না, বরং উন্নত ব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনবল গঠন এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের দিক থেকেও লাভবান হবে।
বিশ্ববাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস ও মেনজিসের এই আগ্রহ বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে। তবে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়নে প্রজ্ঞা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে—এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।
সূত্র: বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন
বাংলাবার্তা/এমএইচ