
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের টানা হামলায় একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও ২০০-র বেশি মানুষ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষুধায় কাতর হয়ে ত্রাণ সংগ্রহে আসা সাধারণ মানুষ, এমনকি শিশুও। চলমান সংঘাতে মানবিক বিপর্যয় যে কতটা ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা এই ঘটনার মধ্য দিয়েই আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার (১১ জুন) স্থানীয় সময় ভোর থেকে গাজা উপত্যকার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনী ড্রোন, ট্যাংক ও স্নাইপারসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে লাগাতার অভিযান চালায়। এসব হামলায় প্রাণ হারান কমপক্ষে ৭০ জন ফিলিস্তিনি—এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় চিকিৎসা কর্মকর্তারা, যা প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
এই ভয়াবহ ঘটনার কেন্দ্রস্থলে ছিল গাজার কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত নেতসারিম করিডর। এটি ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি করিডর, যেখানে সম্প্রতি বিতর্কিত মানবিক ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালু হয়েছে। মঙ্গলবার এখানে খাবার সংগ্রহে আসা মানুষের ভিড়ে গুলি চালায় ইসরায়েলি সেনারা।
গাজা সরকারের তথ্য অফিস জানায়, সেখানে গুলিতে কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে মাত্র ১২ বছর বয়সী শিশু মোহাম্মদ খলিল আল-আথামনেহ। আহত হয়েছেন অন্তত ২০০ জন।
এই করিডরের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি সংস্থা, যার কর্মকাণ্ড ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে গভীর বিতর্ক। সংস্থাটির কার্যক্রম ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে চলছে এবং এটি এমন এলাকাগুলোতে কাজ করছে যেগুলো পুরোপুরি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ এই সংস্থাটিকে আখ্যায়িত করছেন ‘মানব কসাইখানা’ হিসেবে। গাজা সরকারের তথ্য অফিসের ভাষায়— “জিএইচএফ কার্যত একটি ‘মরণ ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে, যেখানে ত্রাণের লোভ দেখিয়ে নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত মানুষদের টেনে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এটি এখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে এক ভয়ঙ্কর হাতিয়ার।”
প্রসঙ্গত, সংস্থাটি গত ২৭ মে থেকে গাজায় তাদের বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এর কেন্দ্রগুলোতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫০ জনের বেশি, আর আহত হয়েছেন প্রায় ১৫০০ জন।
আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজ্জুম, যিনি বর্তমানে গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকা থেকে রিপোর্ট করছেন, তিনি জানিয়েছেন—জিএইচএফ-এর এসব ত্রাণকেন্দ্র এখন যেন “পুনরাবৃত্ত রক্তপাতের মঞ্চ” হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, “ইসরায়েলি সেনারা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এসব ত্রাণকেন্দ্রে ঢুকে সাধারণ মানুষদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। মানবিক সহায়তা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এটা একটি সুপরিকল্পিত অভিযান। কিছু মানুষকে ট্রাকের আশায় দাঁড় করিয়ে রেখে বিভিন্ন দিক থেকে স্নাইপার ও ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে।”
ইসরায়েলের এই নিষ্ঠুর অভিযানে যখন গাজা রক্তাক্ত, তখন মানবিক বিপর্যয়ও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ এক বিবৃতিতে জানায়, “গাজায় মানবিক সংকট এখন অভূতপূর্ব হতাশার পর্যায়ে পৌঁছেছে। চরম অপুষ্টি ও খাদ্য সংকটে ভুগছে লাখ লাখ মানুষ।”
সংস্থাটির মতে, গত মে মাসের শেষ সপ্তাহেই ৫ বছরের নিচে বয়সী অন্তত ২৭০০ শিশুকে চরম অপুষ্টিতে ভোগা অবস্থায় শনাক্ত করা হয়েছে।
তারা সতর্ক করে বলেছে, “মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা পুনরায় কার্যকর না হলে, কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে।”
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজায় কঠোর অবরোধ জারি করে রেখেছে। সেই সময় থেকে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় ত্রাণ সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র জিএইচএফ-এর মতো বিতর্কিত সংস্থাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে ত্রাণ বিতরণের জন্য, যার কার্যক্রমকেই এখন এক ধরনের মরণ ফাঁদ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানান, যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে গাজা পরিস্থিতির ভয়াবহতা থেকে বোঝা যায়, বাস্তবতা এখনও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আল জাজিরার তথ্যমতে, ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী দুটি দলের মন্ত্রীর ওপর যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা ইসরায়েলি রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। একইসঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছে একটি মুসলিম দেশের ইসরায়েলের কাছে গোপনে তেল রপ্তানির তথ্য, যা আরব দুনিয়ায় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
যদিও ইসরায়েল দাবি করে আসছে যে, তারা হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, বাস্তবতা হলো—এই যুদ্ধ এখন আর কেবল একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরং পুরো জনগোষ্ঠীকে মানবিক দুর্দশায় ঠেলে দেওয়ার লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।
ত্রাণের লোভে গুলি খাওয়া, শিশুর ক্ষুধায় মৃত্যু, চিকিৎসা না পেয়ে পথেই মৃত্যুবরণ করা—এসব এখন গাজার প্রতিদিনের চিত্র। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এবং কার্যকর উদ্যোগের অভাবে এই নৃশংসতা দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যার পরিণতি ভয়াবহ হতে চলেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ