
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘিরে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা ও চাপের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (চলতি অর্থবছর) জন্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস অপরিবর্তিত রেখেছে। আজ মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস (জিইপি)’ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বাড়বে—যা ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত পূর্বাভাসের অনুরূপ।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাসটি এমন সময় এলো, যখন বাংলাদেশ তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, দেশটির ভোক্তা ব্যয় এবং বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা অর্থনীতিকে কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোতে দিচ্ছে না।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বছরের প্রথম ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু তিন মাস পর, এপ্রিলে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে করা একটি হালনাগাদ প্রতিবেদনে তারা পূর্বাভাস সংশোধন করে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ করে। আর আজ প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনেও সেই হারই বজায় রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ, জানুয়ারির তুলনায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে কিছুটা নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছে এবং পরবর্তী দুই পূর্বাভাসেই অর্থনৈতিক গতি কমবে বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক খাতে দুর্বলতা ভোক্তা ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে, যার ফলে চাহিদা কমে গেছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা বাড়ায় ব্যয় সংকোচনের চাপ পড়েছে সরকারে ওপরও। এই কারণে সরকার চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বাজেটে বড় পরিসরের রাজস্ব ঘাটতি এবং জিডিপির তুলনায় ঋণ-অনুপাত নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা কৌশল নিচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চলতি অর্থবছরের জন্য সাময়িক জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের তুলনায় কিছুটা বেশি। বিবিএসের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। যদিও এটিও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম (বাজেটে ধার্য ছিল ৬ শতাংশ) এবং বাস্তব অর্থনীতির দুরবস্থা প্রতিফলিত করে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিবিএস ও বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের এই পার্থক্যের মূল কারণ হলো—দুটি প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিগত পার্থক্য। বিশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধি নির্ধারণে একটি কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে এবং বিভিন্ন ঝুঁকিকে বিবেচনায় নেয়, বিশেষত বিনিয়োগ প্রবণতা, ভোক্তা আস্থা, বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি এবং নীতিগত সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা। অন্যদিকে, বিবিএস স্থানীয় তথ্য ও খাতভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সাময়িক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে।
বিশ্বব্যাংকের আজকের প্রতিবেদনে শুধু চলতি অর্থবছরের নয়, বরং আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্পর্কেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। তবে এই পূর্বাভাসও জানুয়ারিতে দেওয়া পূর্বানুমানের চেয়ে ০ দশমিক ৫ শতাংশ কম, কারণ তখন এই হার ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
এ থেকে স্পষ্ট—বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরগতির এক দীর্ঘ সময়ের মধ্যে প্রবেশ করছে, যেখানে বিনিয়োগ ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার না হলে অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হার কিছুটা কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ এখান থেকে মাঝামাঝি অবস্থানে থাকলেও, অতীতের তুলনায় এটি স্পষ্টভাবে নিচের দিকে।
বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যয় ও পণ্যের প্রতিযোগিতা কমছে। পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, রেমিট্যান্স প্রবাহের অস্থিরতা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা এসব কারণে সামগ্রিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে পরামর্শ দিয়েছে যে, বাংলাদেশকে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কাঠামোগত সংস্কারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—রফতানিমুখী খাতকে আরও বহুমুখীকরণ, আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করা, কর ব্যবস্থার সংস্কার এবং সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করা।
এছাড়াও তারা উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হলে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সহজ না করলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাতে পারেন, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি সতর্ক সংকেত। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশে সীমিত থাকার অর্থ হলো—উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং জীবনযাত্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমন বাস্তবতায় সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক গতি পুনরুদ্ধার করা, যার জন্য প্রয়োজন হবে সময়োপযোগী, কার্যকর এবং বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ