
ছবি: সংগৃহীত
নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরও বাস্তবায়নে এখনও বাধার মুখে পড়েছে। আগামী ১৫ জুন থেকে নেপালের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ বাংলাদেশ এখনো লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খুলতে পারেনি। এই সমস্যা থেকেই বিদ্যুৎ রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
গত মঙ্গলবার (১০ জুন) নেপালের প্রধান সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) কর্তৃক প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায়, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটির (এনইএ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ২০২৩ সালের বকেয়া বিল পরিশোধ করেনি, ফলে আগামী ১৫ জুন থেকে নেপালের বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতির ওপর নির্ভরশীল। তবে এখনও প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়নি এবং এ বিষয়ে কাজ চলছে। পিডিবির সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) আ ন ম ওবায়দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে এবং আমরা চাই বিদ্যুতের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার রিজিওনাল কানেক্টিভিটি গড়ে তোলা হোক।”
এদিকে, বাংলাদেশে নেপালের বিদ্যুৎ আমদানির প্রাথমিক পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হয় গত বছরের ১৫ নভেম্বর। ওইদিন ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারতের গ্রিড লাইন ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এই বিদ্যুৎ রপ্তানি চুক্তি ২০২৩ সালের মার্চে কার্যকর হয়, যা তিন দেশের – নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক চুক্তির অংশ।
তবে কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর নভেম্বরের ওই পরীক্ষামূলক আমদানির পর এখনও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের পক্ষ থেকে অর্থ পরিশোধ হয়নি, যা রপ্তানি কার্যক্রমে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। পিডিবির পক্ষ থেকে এই দাবিকে তারা অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, “নেপালের কোনো বিল বকেয়া নেই।” তবে এ বিষয়ে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয় এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে, যখন দুটি দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে মূল চুক্তিটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পূর্ণতা পায়নি। পরে, গত বছরের ৩ অক্টোবর তিন দেশের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার আওতায় প্রতি বছর বর্ষাকালে সাত মাস নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হবে। এই বিদ্যুৎ ভারতের গ্রিড লাইন ব্যবহার করে পাঠানো হবে, যেটি ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে।
গত বছরের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেপাল থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব মন্ত্রিসভার ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে অনুমোদিত হয়। সেসময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয় ৮ টাকা ১৭ পয়সা, যা বাংলাদেশের গড় উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় খরচ প্রতি ইউনিট প্রায় ১১ টাকার বেশি।
বৈঠক অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১৩০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনার পরিকল্পনা করেছে, যা পাঁচ বছর ধরে মোট ৬৫০ কোটি টাকা হবে। নেপালের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে বাংলাদেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে এবং এতে দেশীয় বিদ্যুৎ সেক্টরের চাপ কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।
তবে, এই দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে সমন্বয় এবং যথাযথ অর্থায়ন না হওয়ায় এখন পর্যন্ত কার্যক্রম শুরু হয়নি। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সঠিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নেপালের বিদ্যুৎ আমদানির এই বিলম্বে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলায় আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগেও ধাক্কা লেগেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশগুলো একে অপরকে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবেলা করার স্বপ্ন এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি চাপ বাড়ছে। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা না হওয়া পর্যন্ত এই স্থগিত অবস্থা চলতেই পারে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অতএব, আগামী ১৫ জুন থেকে শুরু হওয়া নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির প্রত্যাশিত কার্যক্রম স্থগিত হওয়া দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সহযোগিতার জন্য বড় ধাক্কা বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার কবে এই জটিলতা কাটিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি বাস্তবায়নে সক্ষম হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ