
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসন কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তিনটি ধাপে দেশজুড়ে নতুন করে গঠন করা হবে ১২টি কাস্টম হাউস ও ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) কমিশনারেট। দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব সংগ্রহে ঘাটতি, ভৌগোলিক অসামঞ্জস্যতা এবং অতিরিক্ত কাজের চাপে ভুগতে থাকা বিদ্যমান অফিসগুলোর দক্ষতা বাড়াতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
প্রথম ধাপে ৫টি নতুন ইউনিট
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম ধাপে গঠিত হবে ৫টি নতুন ইউনিট। এর মধ্যে ৩টি হবে ভ্যাট কমিশনারেট এবং ২টি হবে কাস্টমস কমিশনারেট। এ নিয়ে বর্তমানে ১২টি ভ্যাট কমিশনারেট বাড়িয়ে ১৫টিতে উন্নীত করা হবে, আর কাস্টমস কমিশনারেট হবে ১২টি।
ভ্যাট কমিশনারেটগুলো হবে— রাজশাহী ভ্যাট কমিশনারেট (নতুন), রংপুর ভ্যাট কমিশনারেট (নতুন) ও কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেট (নতুন)।
বর্তমানে এসব অঞ্চলে একটি করে ভ্যাট অফিস থাকলেও, কমিশনারেট পর্যায়ের কাঠামো ছিল না। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের সেবা দেওয়া, ভ্যাট নিরীক্ষা এবং রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা মোকাবিলা নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছিল।
অন্যদিকে, কাস্টমসের ক্ষেত্রেও দুইটি নতুন কমিশনারেট গঠিত হবে—
বেনাপোল কাস্টম হাউস (পুনর্গঠন করে পূর্ণাঙ্গ কমিশনারেট)
চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে নতুন কাস্টম কমিশনারেট
দ্বিতীয় ধাপে আরো ৪টি কমিশনারেট
দ্বিতীয় ধাপে এনবিআর গঠন করবে আরও ৪টি কমিশনারেট। এর মধ্যে ২টি হবে ভ্যাট কমিশনারেট এবং ২টি কাস্টমস কমিশনারেট। সম্ভাব্য নতুন ইউনিটগুলোর মধ্যে রয়েছে—
খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে একটি করে ভ্যাট কমিশনারেট
আখাউড়া ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত এলাকায় নতুন কাস্টমস কমিশনারেট
এই ধাপটি বাস্তবায়ন হবে আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে। এনবিআর সূত্র বলছে, এই ধাপে স্থানভিত্তিক রাজস্ব সংগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা বুঝে অফিস স্থাপন করা হবে।
তৃতীয় ধাপে বাকি ৩টি ইউনিট
তৃতীয় ধাপে গঠিত হবে ৩টি কমিশনারেট, যার মধ্যে ১টি কাস্টমস ও ২টি ভ্যাট কমিশনারেট থাকবে। সম্ভাব্য এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে:
সিলেট বিভাগে আরও একটি ভ্যাট কমিশনারেট
ঢাকার আশেপাশে (গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জে) একটি নতুন কাস্টম হাউস
ময়মনসিংহে পূর্ণাঙ্গ ভ্যাট কমিশনারেট
এই ধাপ বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২৭-২৮ অর্থবছর।
কেন এই পরিবর্তন?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মাত্র ১১টি কাস্টম হাউস ও ১২টি ভ্যাট কমিশনারেট কাজ করছে। তুলনায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি রাজ্যে একাধিক জিএসটি কমিশনারেট রয়েছে। জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তুলনায় বাংলাদেশে বিদ্যমান কাঠামো যথেষ্ট নয়। এতে রাজস্ব ফাঁকি, আইনি দুর্বলতা ও সেবা সংকট বাড়ছে।
অন্যদিকে, এনবিআরের রিপোর্ট বলছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। প্রায় ৭০ শতাংশ রাজস্ব এখন এই দুই অঞ্চলের কমিশনারেটগুলো থেকে আসে, যেখানে স্থানীয় ব্যবসার পরিধি ছাড়িয়ে জাতীয় পরিমাণে কাজ করতে হয়।
জনবল ও বাজেট
প্রতিটি কমিশনারেট গঠনে অতিরিক্ত জনবল ও অবকাঠামোগত বাজেট বরাদ্দ লাগবে। এনবিআরের পরিকল্পনায় প্রাথমিকভাবে প্রতিটি নতুন কমিশনারেটে একজন কমিশনার, দুইজন অতিরিক্ত কমিশনার, চারজন যুগ্ম কমিশনার এবং সহকারী কমিশনারসহ প্রায় ৬০-৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে।
এনবিআর বলছে, নতুন কমিশনারেটগুলোর জন্য ভবন, যানবাহন, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন করা হবে।
ব্যবসায়ী মহলের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ইতিমধ্যে এনবিআরের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলছে, “এতদিন ঢাকাকেন্দ্রিক কর প্রশাসন ছিল একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। নতুন কমিশনারেটগুলো হলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সহজ হবে এবং রাজস্ব প্রবাহ বাড়বে।”
তিন ধাপে গঠিত এই ১২টি নতুন কমিশনারেট দেশের রাজস্ব কাঠামোয় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। এটি একদিকে যেমন রাজস্ব আহরণে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা বাড়াবে, তেমনি করদাতাদের সেবা প্রদান ব্যবস্থাও হবে আরও বিকেন্দ্রীকৃত ও সহজলভ্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ