
ছবি: সংগৃহীত
দেশে আবারও বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, মূলত ওমিক্রনের একাধিক নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট—বিশেষ করে বিএ.২.৮৬, জেএন-১, এক্সএফজি, এনবি.১.৮.১ এবং এলএফ.৭—দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় এ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও বন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি হয়েছে, চালু হয়েছে কোভিড ওয়ার্ড, সীমান্তে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি।
শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দুজন নারী। একজন ঢাকার, অন্যজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা। এর আগে ৫ জুন একজনের মৃত্যু হয়। একই সময়ে ১৭৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে ২০২৫ সালে এ পর্যন্ত মোট ২৫৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, যাদের ৯৭ জনই আক্রান্ত হয়েছেন চলতি জুন মাসে।
আইইডিসিআরের সর্বশেষ কোভিড সার্ভিলেন্স এবং জিনোম সিকুয়েন্সিং বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটাচ্ছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিএ.২.৮৬ এবং এক্সএফজি উপধরন। মে মাসে ১,৪০৯টি সন্দেহভাজন নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৩৪টি নমুনায় কোভিড পজিটিভ ধরা পড়ে—সংক্রমণের হার দাঁড়ায় ৯.৫১ শতাংশে, যা ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সময়ে সর্বোচ্চ।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জানান, এখন পর্যন্ত ওমিক্রনের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্টগুলো আগে যেসব ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেছে, তার চেয়ে কম প্রাণঘাতী হলেও সংক্রমণের হার অনেক বেশি। ফলে ভাইরাসটি অনেক বেশি মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম। তিনি বলেন, “প্রথম দিকে উপসর্গগুলো মৌসুমি জ্বর বা সাধারণ সর্দি-কাশির মতো মনে হলেও ভাইরাসটি তীব্র গতিতে ছড়াতে পারে। তাই সচেতন না হলে এই সংক্রমণ মৃত্যু বাড়াতে পারে।”
আইইডিসিআরের সায়েন্টিফিক অফিসার ডা. মো. আব্দুল্লা ওমর নাসিফ বলেন, “নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে বয়স্ক, গর্ভবতী ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের মধ্যে।”
ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এনবি.১.৮.১ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এটি ওমিক্রনের একটি শক্তিশালী উপধরন, যার সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। বিশ্বজুড়ে জেনেটিক সিকুয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এ সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতে এর বিস্তার বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়েছে।
ঢাকায় ১০২টি নমুনার মধ্যে ৯টি পজিটিভ পাওয়া গেছে, চট্টগ্রামে ৪৬টির মধ্যে ২টি, কক্সবাজারে ১টি, কুমিল্লায় ২টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি। চট্টগ্রামে নতুন দুই রোগী শনাক্ত হওয়ায় এ জেলায় চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ জনে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “নগরীর একটি বেসরকারি রোগ নিরূপণ কেন্দ্রে পরীক্ষা করে দুজনের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তারা ঘরে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।”
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের সব বড় চিকিৎসা কেন্দ্রে আবারও চালু করা হয়েছে র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও আরটিপিসিআর টেস্টিং ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও চসিকের মেমন-২ হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড ইউনিট হিসাবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। হাসপাতালের নতুন ভবনের ৮ম তলায় চালু করা হয়েছে ২০ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড। ওয়ান স্টপ সার্ভিসে পর্যাপ্ত কিট সরবরাহ করা হয়েছে, চালানো হচ্ছে জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে তাদের করোনা ইউনিটের আইসিইউতে একজন রোগী ভর্তি রয়েছেন, আরও পাঁচজন হোম আইসোলেশনে রয়েছেন।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরে প্রবেশে বাধ্যতামূলক করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্কের ব্যবহার। আগত বিদেশি জাহাজের নাবিকদের জন্য চালু হয়েছে থার্মাল স্ক্যানিং ব্যবস্থা। মোংলা বন্দরের উপপরিচালক (বোর্ড ও জনসংযোগ) মো. মাকরুজ্জামান বলেন, “ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে আমরা বন্দরে বিশেষ সতর্কতা বাস্তবায়ন করেছি।”
অন্যদিকে দিনাজপুরের হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে স্থাপন করা হয়েছে মেডিকেল টিম। কিন্তু কিট সংকটে এখনো করোনা পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইলতুতমিশ আকন্দ বলেন, “আমরা নমুনা সংগ্রহ করছি এবং জ্বর বা অসুস্থতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক সতর্কবার্তা দিচ্ছি। তবে কিট না থাকায় পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। চাহিদা পাঠানো হয়েছে।”
দেশে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ শুরু হওয়ায় সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। এতে ভারতসহ সংক্রমণপ্রবণ দেশগুলোতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ না করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভাইরাস মোকাবিলায় সবাইকে মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়ানো এবং উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি সতর্ক না হওয়া যায়, তাহলে সংক্রমণের হার আরও বেড়ে যেতে পারে। গত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সংক্রমণের শুরুর দিকে সাধারণ উপসর্গ থাকলেও পরবর্তীতে তা জটিল আকার ধারণ করে। তাই জনগণকে সচেতন হওয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে টেস্টিং সক্ষমতা, হাসপাতাল প্রস্তুতি ও সীমান্ত পর্যবেক্ষণ জোরদার করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সজাগ দৃষ্টিভঙ্গিই হতে পারে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ