
ছবি: সংগৃহীত
তীব্র উত্তেজনার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য আবারও ধাবিত হচ্ছে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। শুক্রবার (১৩ জুন) রাতভর ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মিসাইল হামলার ঘটনায় তেলআবিবসহ গোটা ইসরাইলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ইরানের বিস্ফোরক জবাবের মুখে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজসহ নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতারা আশ্রয় নেন একটি সুরক্ষিত বাংকারে। সেখানে তারা রাতভর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণে জরুরি বৈঠক করেন।
ইসরাইলের এক সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হওয়ার পরপরই একটি বিশেষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ওই সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন সেনাপ্রধান, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা।
বলা হচ্ছে, শুক্রবার ভোরে ইরান প্রথম হামলার শিকার হয়। ইসরাইল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নাম দিয়ে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় আঘাত হানে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও ইরানি সংবাদ সংস্থা ইরনা জানায়, এই অভিযানে ইরানের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পারমাণবিক কর্মকর্তা নিহত হন। তাদের মধ্যে রয়েছেন—
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি
আইআরজিসির (ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী) প্রধান হোসেইন সালামি
খতম-আল আম্বিয়া সামরিক সদর দপ্তরের কমান্ডার জেনারেল গোলামআলি রশিদ
পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও ইরানের পারমাণবিক সংস্থার সাবেক প্রধান ফেরেদুন আব্বাসি
এই ক্ষয়ক্ষতির প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার রাতেই শুরু হয় ইরানের পাল্টা প্রতিশোধ। ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’ নামের এই অভিযানকে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় “কৌশলগত ও প্রতিশোধমূলক আঘাত” বলে ঘোষণা করেছে। ইরান দাবি করেছে, তারা কয়েকশ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে যার বেশিরভাগই লক্ষ্য ছিল তেলআবিব, হাইফা এবং ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় সামরিক ঘাঁটিতে।
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রামজান শরিফ জানান, “আমরা আমাদের শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। শত্রু জানুক, ইরান প্রতিটি প্রাণের মূল্য জানে এবং তার জবাব দেবে দ্বিগুণ শক্তিতে।” তিনি আরও বলেন, “ইসরাইলের অস্ত্রাগার ও সামরিক কমান্ড সেন্টারে সফলভাবে আঘাত হেনেছে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র।”
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিবের বাণিজ্যিক এলাকায় আঘাত হানলে অন্তত ২১ জন আহত হন, যাদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, আকাশজুড়ে ইসরাইলি আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তৎপরতা ও শহরজুড়ে সাইরেন বেজে উঠছে।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, সরকারিভাবে হতাহতের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি, তবে তেলআবিব ও আশদোদের কয়েকটি সামরিক অবকাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং জনগণকে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ড. অ্যারন কার্ন জানান, “ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে এই মাত্রার সামরিক মিথোপক্রিয়া অঞ্চলজুড়ে নতুন এক যুদ্ধের শঙ্কা জাগিয়েছে। যদি এই সংঘর্ষ এখনই থামানো না যায়, তাহলে এতে যুক্ত হতে পারে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিও, যেমন—হিজবুল্লাহ, হুতি এবং সৌদি আরবের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।”
মধ্যপ্রাচ্য গবেষক ও সাবেক কূটনীতিক রবার্ট ফিস্ক বলেন, “ইসরাইল হয়তো চেয়েছিল তেহরানকে শায়েস্তা করতে, কিন্তু ইরানের এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং উচ্চপর্যায়ের ক্ষয়ক্ষতি নতুন এক ফ্রন্ট খুলে দিয়েছে।”
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই উত্তেজনা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য উদ্যোগ নেওয়া দরকার।”
হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পরিস্থিতির উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, “আমরা উভয়পক্ষকে শান্ত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। আমেরিকা কোনো উস্কানিকে সমর্থন করে না।”
তীব্র উত্তেজনার এই পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক, কাতার, ফ্রান্স ও চীনসহ একাধিক দেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি নেতানিয়াহু সরকারের প্রতিক্রিয়া আরও আক্রমণাত্মক হয়, তাহলে এই লড়াই আরও বিস্তৃত ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে।
ইরান ও ইসরাইলের এই সামরিক সংঘর্ষ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। শুক্রবারের ঘটনাগুলো এই বার্তাই দেয়—প্রতিশোধের রাজনীতিতে পরিণাম শুধু ধ্বংস। এখন প্রশ্ন হলো, দুই পক্ষ কি শত্রুতার পথ থেকে সরে এসে সংলাপের পথে হাঁটবে, নাকি এই সংঘর্ষ পরিণত হবে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ