
ছবি: সংগৃহীত
চার দিনের সরকারি সফর শেষে যুক্তরাজ্য থেকে দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা ১৫ মিনিট) বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তার সফরসঙ্গীরাও একই ফ্লাইটে ফিরছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
চার দিনের সফরে ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য যাত্রা কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য সাক্ষাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এ সফর ছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সফরের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মতবিনিময়।
প্রধান উপদেষ্টার সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক। শুক্রবার লন্ডনে এক দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মুখোমুখি হন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বলে জানা গেছে।
বৈঠক শেষে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, তারেক রহমান প্রস্তাব করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য দ্রুত সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ড. ইউনূস বলেন, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালে রমজান মাস শুরুর আগের সপ্তাহেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হতে পারে। তবে তিনি শর্তস্বরূপ উল্লেখ করেন, নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।
এই মন্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকার কেবল একটি নির্বাচন পরিচালনা করতে চায় না—বরং দেশে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকেও এগোচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরের আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে তার বৈঠক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ। বৃহস্পতিবার, বাকিংহাম প্যালেসে রাজা চার্লসের সঙ্গে তার সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় ড. ইউনূসকে “কিং চার্লস তৃতীয় হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫” প্রদান করা হয়।
এই পুরস্কারটি তাকে দেওয়া হয়েছে তার আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ। এই সম্মাননা আন্তর্জাতিক মহলে ড. ইউনূসের মর্যাদা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সফরকালে ড. ইউনূস যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের স্পিকারসহ দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (LSE)-এ আয়োজিত একটি গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন।
এবারের সফরে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিষয়টি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ড. ইউনূস এই সফরে যুক্তরাজ্য সরকারকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি বিস্তারিত তালিকা উপস্থাপন করেছেন, যেখানে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থ পাচার ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
শফিকুল আলম আরও জানান, হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২4 সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাজ্যে রয়েছে বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে। এই অর্থ ফেরত আনতে যুক্তরাজ্যের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও সমঝোতা হচ্ছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিপুল সম্পদ জব্দ করার ঘটনা এই প্রক্রিয়ার একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশকে সম্পদ পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে এবং ভবিষ্যতেও তারা এই বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ।
প্রধান উপদেষ্টার এই সফর কেবল কূটনৈতিক দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। তার সফর শেষে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফরের মাধ্যমে ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি দেশের জনগণকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুশাসনভিত্তিক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এখন দেখার বিষয়, দেশে ফিরে তিনি এই আন্তর্জাতিক অগ্রগতিকে কীভাবে ঘরোয়া রাজনৈতিক সমঝোতা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে রূপান্তর করতে পারেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ