
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার পারদ ফের চরমে। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকর সংঘাত আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, শনিবার (১৪ জুন) মধ্যরাতের ঠিক পরপরই ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব এবং ফিলিস্তিনের দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেম লক্ষ্য করে আবারও ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইরান। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এই হামলার সময় স্থানীয় সময় রাত ১টা ৩০ মিনিট। রয়টার্সের প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, মিসাইল সদৃশ একটি বস্তু তেলআবিবে আছড়ে পড়ার পর ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠে আসছে। বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই প্রবল ছিল যে আশেপাশের এলাকা কেঁপে উঠে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা।
এই হামলার পরপরই ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) জরুরি সতর্কতা জারি করে। দেশটির নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং জানিয়ে দেওয়া হয়—পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বাইরে বের হওয়া যাবে না। পুরো রাজধানী ও জেরুজালেমে সাইরেন বেজে ওঠে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম অত্যাধুনিক মিসাইল নিক্ষেপ করেছে ইরান, যা স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরান এই হামলার দায় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ইসরাইলের পূর্বের একাধিক আক্রমণের জবাব হিসেবেই এই হামলা চালানো হয়েছে। বিশেষ করে ইসরাইলের দখলদার বাহিনীর তৎপরতা ও ইরান সীমান্তের অভ্যন্তরে চালানো গুপ্ত হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটি পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এর আগে, ইরান দাবি করেছিল, ইসরাইল তেহরান ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অঞ্চলগুলোতে হামলা চালিয়েছে এবং এতে অন্তত ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এই নতুন হামলা সংঘটিত হলো।
অন্যদিকে, মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস এবং সিএনএন আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ইসরাইল এবার ইরানের রাষ্ট্রপতি মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি-কে টার্গেট করে হামলার চেষ্টা করছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, ইরানের রাজধানী তেহরানের পাস্তুর এলাকা—যেখানে প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম নেতা বাস করেন—সেই এলাকায় ইসরাইলি মিসাইল আঘাত হানার চেষ্টা করে। তবে ইরানি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই হামলা প্রতিহত করে।
তেহরানের সাধারণ জনগণের ভাষ্য অনুযায়ী, পুরো এলাকা রাতজুড়ে আতঙ্কের মধ্যে ছিল এবং প্রতিনিয়ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে মিসাইল ছোঁড়া হচ্ছিল। সেখানে থাকা প্রতিরক্ষা রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ইসরাইলি ড্রোন ও মিসাইল শনাক্ত করে সেগুলোর গতিপথ আটকে দেয়।
হামলা-পাল্টা হামলার এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। রয়টার্স জানায়, ইরান আগেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে একযোগে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। তখন ইসরাইলকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল—এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, গোয়েন্দা তথ্য ও আকাশ প্রতিরক্ষা সহায়তা দিয়ে। এবারও তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না এই সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ুক। তবে ইসরাইল যদি নেতৃত্বে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তার মিত্রকে একা ফেলে দেবে না।
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে এভাবে পাল্টাপাল্টি হামলা চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্য যে বড় আকারের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ অঞ্চলের ভঙ্গুর রাজনীতি, শত্রু রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং বিশ্বশক্তিগুলোর অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর (যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি, শিয়া মিলিশিয়া) সক্রিয় অবস্থান, আবার ইসরাইলের পাশে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পশ্চিমা জোটের অবস্থান এক নতুন ধরণের Cold-War Style Proxy Conflict তৈরি করেছে।
ইরান-ইসরাইলের এই সামরিক উত্তেজনার ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতাও দেখা দিয়েছে। আগের হামলার পর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৯% পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। এই নতুন হামলার প্রেক্ষাপটেও বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ ও রয়টার্সের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্ববাসী এখন শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ যে শুধু দুটি দেশের নয়, তা একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে। প্রতিটি হামলা নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিচ্ছে। ইরান যদি সরাসরি ইসরাইলের ভেতরে হামলা চালায় এবং ইসরাইল যদি পাল্টা প্রেসিডেন্ট বা সুপ্রিম লিডারকে টার্গেট করে, তাহলে এ সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এই রকম সংঘর্ষ বিশ্বশান্তির জন্য বড় হুমকি। আন্তর্জাতিক মহলের এখন দরকার গঠনমূলক মধ্যস্থতা এবং যুদ্ধ নয়, বরং কূটনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ