
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন করে উত্তেজনার ঝড় বইছে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সামরিক হামলার কারণে। দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়—তবে এবার তা যেন ভয়াবহ সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি ইসরাইল তেহরান ও আশপাশের এলাকায় অবস্থিত ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ২০০টির বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। জবাবে ইরানও শতাধিক ড্রোন ব্যবহার করে ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিব ও এর আশপাশের এলাকায় পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
এই টানটান পরিস্থিতিতে সবার চোখ এখন মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রভাবশালী দেশের দিকে। প্রশ্ন উঠছে—সামরিক শক্তিতে কে কাকে টেক্কা দিতে পারে? যদি সরাসরি যুদ্ধে গড়ায়, তাহলে কী হবে? গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ও অন্যান্য সামরিক পর্যবেক্ষণ সংস্থার বরাতে দুই দেশের সামরিক শক্তির তুলনা বিশ্লেষণ করা হলে উঠে আসে এক চমকপ্রদ চিত্র।
সামরিক ক্ষমতার সামগ্রিক অবস্থান
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার (Global Firepower) ২০২৫ সালের সামরিক শক্তি র্যাংকিং অনুযায়ী, ইরান বর্তমানে বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে ১৬তম, আর ইসরাইল রয়েছে ১৫তম অবস্থানে। অর্থাৎ সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতার বিচারে দু'দেশের মধ্যে ব্যবধান খুবই কম।
সামরিক বাজেট: অর্থনৈতিক সক্ষমতায় এগিয়ে ইসরাইল
সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে ইসরাইল ইরানকে ছাড়িয়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি।
ইসরাইল: বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ২৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
ইরান: বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ৯.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
অর্থাৎ, উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে সামরিক খাতে আধুনিকীকরণে ইসরাইল অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে পারছে।
সৈন্য সংখ্যা: সংখ্যায় এগিয়ে ইরান
তবে সৈন্য সংখ্যার বিচারে ইরান অনেক বেশি এগিয়ে।
ইরান:
মোট সামরিক জনবল: ১১,৮০,০০০
রিজার্ভ বাহিনী: ৩,৫০,০০০
ইসরাইল:
মোট সামরিক জনবল: ৬,৭০,০০০
রিজার্ভ বাহিনী: ৪,৬৫,০০০
ইরানের বড় সেনাবাহিনী প্রমাণ করে যে, কোনো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে তারা বেশি টিকে থাকতে পারে, বিশেষ করে ভূমিভিত্তিক সংঘাতে।
আকাশ শক্তি: আধুনিকতায় এগিয়ে ইসরাইল
বিমান ও হেলিকপ্টার সংখ্যা ও সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইল বেশ আধুনিক ও সমৃদ্ধ।
মোট বিমান:
ইরান: ৫৫১টি
ইসরাইল: ৬১২টি
যুদ্ধবিমান:
ইরান: ১৮৬টি
ইসরাইল: ২৪১টি
প্রশিক্ষণ বিমান:
ইরান: ১০২টি
ইসরাইল: ১৫৫টি
অ্যাটাক বিমান:
ইরান: ২৩টি
ইসরাইল: ৩৯টি
হেলিকপ্টার:
ইরান: ১২৯টি (অ্যাটাক হেলিকপ্টার ১৩টি)
ইসরাইল: ১৪৬টি (অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৪৮টি)
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আকাশ থেকে টার্গেট করা, নজরদারি এবং হঠাৎ হামলার ক্ষেত্রে ইসরাইলের আধুনিক ও কার্যকর বিমানবাহিনী বড় প্রভাব রাখতে পারে।
স্থলশক্তি: সংখ্যায় শক্তিশালী ইরান
ইরান স্থলযুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধ ক্ষমতায় এগিয়ে রয়েছে সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক সংখ্যার দিক থেকে।
ট্যাংক:
ইরান: ১,৯৯৬টি
ইসরাইল: ১,৩৭০টি
সাঁজোয়া যান:
ইরান: ৬৫,৭৬৫টি
ইসরাইল: ৪৩,৪০৩টি
এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ইরান স্থলভিত্তিক কনভেনশনাল যুদ্ধের জন্য আরও প্রস্তুত।
আর্টিলারি ও রকেট সিস্টেম
ইরান:
সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি: ৫৮০টি
রকেট আর্টিলারি (MLRS): ৭৭৫টি
ইসরাইল:
সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি: ৬৫০টি
রকেট আর্টিলারি (MLRS): ১৫০টি
রকেট ও কামান সিস্টেমে ইরান অনেক বেশি নির্ভর করে, যা আঞ্চলিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
নৌশক্তি: ইরানের আধিপত্য
নৌবাহিনীর শক্তি ও উপস্থিতির দিক থেকে ইরান এগিয়ে।
ইরান:
যুদ্ধজাহাজ: ১০১টি
ফ্রিগেট: ৭টি
টহল জাহাজ: ২১টি
সাবমেরিন: ১৯টি
ইসরাইল:
যুদ্ধজাহাজ: ৬৭টি
ফ্রিগেট: ০টি
টহল জাহাজ: ৪৫টি
সাবমেরিন: ৫টি
বিশ্লেষকরা বলছেন, উপসাগরীয় এলাকায় সংঘর্ষ হলে ইরান তার নৌ শক্তিকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
পারমাণবিক অস্ত্র: গোপনীয়তার পর্দায় বিভ্রান্তি
ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) নিশ্চিত করেছে। তারা বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রধারী ৯ দেশের মধ্যে ইসরাইলকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অন্যদিকে, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেনি, বরং তাদের দাবি, পরমাণু কর্মসূচি একান্তই শান্তিপূর্ণ ও গবেষণামূলক। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই অভিযোগ করেছে, ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্য তাদের র্যাংকিংয়ে বিবেচনায় না আনলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ছায়াযুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
সামরিক শক্তির সরল পরিসংখ্যানে কেউ একচেটিয়াভাবে এগিয়ে নেই। ইসরাইলের প্রযুক্তি, আকাশ শক্তি ও কৌশলগত আধুনিকতা যেখানে সুবিধা দেয়, সেখানে ইরানের বিশাল সেনাবাহিনী, রকেট সক্ষমতা ও নৌবাহিনীর প্রভাব যুদ্ধক্ষেত্রে ভারসাম্য তৈরি করে।
তবে বাস্তবতা হলো, এই শক্তি পর্যালোচনা কেবল সম্ভাব্য সংঘাতের পূর্বাভাস দিতে পারে, কিন্তু যুদ্ধ কখনোই কেবল সংখ্যার খেলা নয়। রাজনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক সমর্থন, ভূরাজনীতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থা—সবকিছু মিলেই ঠিক করবে কে আসল বিজয়ী।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এখন আতঙ্কিত—এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি যেন আর বড় কোনো যুদ্ধের রূপ না নেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ