
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটি শেষে রাজধানী ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। আসন্ন কর্মব্যস্ত দিনগুলোর প্রস্তুতি নিতে শনিবার (১৪ জুন) সকাল থেকেই রাজধানীর প্রবেশপথে তৈরি হয় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। আগামীকাল রোববার (১৫ জুন) থেকে সরকারী-বেসরকারি অফিস-আদালত খুলে যাবে। তাই শেষ মুহূর্তে শহরে ফিরে আসছেন হাজারো মানুষ, যার ফলে যানবাহন, টার্মিনাল ও স্টেশনগুলোতে তৈরি হয় জনস্রোত।
শনিবার সকাল থেকেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা—বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনাসহ বহু স্থান থেকে ঢাকামুখী লঞ্চগুলো সদরঘাটে এসে ভিড়তে থাকে। প্রতিটি লঞ্চেই যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। অনেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন, কেউবা একা। কেউ ছাদের ওপর, কেউ সিঁড়িতে, আবার কেউ ডেকে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে রাজধানীর পথে এগিয়ে এসেছেন।
যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চে ভাড়া নিয়ে তেমন সমস্যা না থাকলেও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপের কারণে অনেকেই স্বস্তিতে ভ্রমণ করতে পারেননি। গরম, ঠাসাঠাসি পরিবেশ ও বিশ্রামের অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অনেককে।
রাজধানীর প্রবেশপথ—গাবতলী, মহাখালী ও যাত্রাবাড়ী বাস টার্মিনালে ভোর থেকে শুরু হয় ঢাকামুখী মানুষের স্রোত। দূরপাল্লার বাসগুলো আসতে থাকে একের পর এক, প্রতিটি বাসেই যাত্রীぎぎぎ পরিপূর্ণ। বাস থেকে নেমেই অনেকে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছাতে লেগে পড়ছেন রিকশা, অটোরিকশা কিংবা সিএনজিতে।
তবে ভাড়া নিয়ে দেখা গেছে চরম অসন্তোষ। ঈদের ছুটির পর এমনিতেই যানবাহনের চাহিদা বেশি, তার ওপর প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে যাত্রীরা হয়ে পড়ছেন অসহায়। কিছু কিছু জায়গায় যাত্রীদের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেক যাত্রী বলেন, “গাবতলী থেকে মহাখালী যেতে যেখানে ৩০ টাকার রিকশা ভাড়া, সেখানে ১০০ টাকাও নিচ্ছে। অথচ আমাদের কোনো উপায় নেই।”
বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার ও শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ছিল বড় দুর্ভোগ। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গাড়ি পাননি। আবার অনেকে একরকম বাধ্য হয়েই হেঁটেই রওনা হয়েছেন নিজ গন্তব্যের দিকে।
কমলাপুর রেলস্টেশনেও শনিবার সকাল থেকে শুরু হয় যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। ঈদের ছুটিতে যারা রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছিলেন, তারা পরিবার-পরিজনসহ ফিরতে শুরু করেছেন।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা গেছে, একটি ট্রেন নামতেই দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন স্বজনরা। কেউ মালামাল কাঁধে নিয়ে ছুটছেন, কেউ সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন। স্টেশনজুড়ে বিরাজ করছিল কর্মচঞ্চল দৃশ্যপট।
স্টেশনে আসা এক যাত্রী বলেন, “এবারের ঈদের যাত্রা ভালোই গেল, কিন্তু ফিরে আসাটা কষ্টকর। ট্রেনে দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে পুরোটা পথ।” অন্য একজন বলেন, “টিকিট পাইনি, বিকল্প না থাকায় জেনেও উঠেছি ট্রেনে। অন্তত সময়মতো ঢাকায় আসা যাবে।”
ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে পরিবহন সংকট মিলিয়ে ঢাকায় ফেরার এই যাত্রা যেন অনেকের জন্য ছিল এক রকম যুদ্ধ। রাজধানী প্রবেশের প্রতিটি পয়েন্টে দেখা গেছে অস্বাভাবিক যানজট, যা অনেক ক্ষেত্রে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। ফলে যারা বাসে এসেছেন, তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আরও দীর্ঘ সময় লেগেছে।
বড় ব্যাগ, সঙ্গে পরিবারের সদস্য—এই অবস্থায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া যাত্রীদের অনেকেই ক্লান্ত-বিষণ্ণ। কেউ কেউ ফ্লাইওভারের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, কেউ পানির খোঁজে ছোটাছুটি করছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া, অসচেতন চালক-সহযোগীদের দুর্ব্যবহার ও সময়মতো যান না পাওয়ার হতাশা।
ভিড় সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সকাল থেকে বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্টেশনে দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ, র্যাব এবং ট্রাফিক বিভাগ যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালালেও অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, “যাত্রীদের ভিড় সামাল দিতে আমরা অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করেছি। ভাড়া সংক্রান্ত অনিয়ম ঠেকাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও কাজ করছে।”
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, বাস থেকে নেমে যাত্রীরা হতাশ হয়ে রিকশা-সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকেই বলছেন, গাড়ি পেলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে তিনগুণ সময় লাগছে। বিশেষ করে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, উত্তরা ও বাড্ডা এলাকায় যানজট ছিল তীব্র।
এক যাত্রী বলেন, “ভাড়া বেশি, গরমে হাঁসফাঁস করছি, কিন্তু গাড়ি নেই। পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য হচ্ছি।”
ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীতে মানুষের এই প্রত্যাবর্তন যেন এক বিশাল মানবিক ঢল। কারও চোখে ঈদের আনন্দের স্মৃতি, আবার কারও মুখে বাড়তি খরচ ও ভোগান্তির আক্ষেপ। তবুও জীবিকার তাগিদে সবাই ফিরছেন কর্মস্থলে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আগেভাগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তবে অনেকটা ভোগান্তি এড়ানো যেত। ভবিষ্যতের যাত্রা যেন হয় আরও সুশৃঙ্খল, যাত্রীবান্ধব ও নিরাপদ—এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ