
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ফের যুদ্ধের গন্ধ। একের পর এক পাল্টা হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া এবং ভয়ংকর হুঁশিয়ারিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। সর্বশেষ শনিবার (১৪ জুন) ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সরাসরি হুমকি দিয়েছেন, যদি ইরান আর কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, তবে পাল্টা জবাবে ‘তেহরানকে জ্বালিয়ে দেওয়া’ হবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি-র বরাত দিয়ে এমন তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাৎজ এক বিবৃতিতে বলেন, “ইরানের স্বৈরশাসক আয়াতুল্লাহরা সাধারণ নাগরিকদের জিম্মি করে নিজেদের সামরিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যস্ত। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে, তাদের এসব কর্মের মাশুল ইরানের সাধারণ মানুষকে দিতে হতে পারে—বিশেষ করে তেহরানবাসীদের।” তিনি আরও বলেন, “যদি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আমাদের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখেন, তাহলে ইরান জ্বলেপুড়ে ছারখার হবে।”
এই হুমকিকে ইসরাইলের ‘ডু অর ডাই’ বার্তা হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। এটি নিছক কথার ফুলঝুরি নয়, বরং একটি সম্ভাব্য পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের ইঙ্গিত।
গত শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় একটি বড় আকারের বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, ড্রোন ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইসরাইল এই অভিযান চালিয়েছে। লক্ষ্য ছিল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ও রাডার স্টেশন। তবে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য জানায়নি ইরান।
এর জবাবে শনিবার ভোররাতে (গতকাল দিবাগত রাত) ইরানও পাল্টা আঘাত হানে। রাজধানী তেল আবিবের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। ইরান দাবি করেছে, তারা ‘আগ্রাসনের জবাবে’ আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছে।
ইসরাইলের হুমকির পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইরানের পক্ষ থেকেও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, এই সংঘাত এখানেই থামছে না। দেশটির আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা ফারস এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, “গতরাতের সীমিত প্রতিক্রিয়া ছিল কেবল সূচনা। ইরানের পক্ষ থেকে জবাবদিহি অব্যাহত থাকবে। এটা আগ্রাসনকারীদের জন্য কষ্টকর ও অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমাদের প্রতিক্রিয়া কৌশলগত এবং ধাপে ধাপে বিস্তৃত হবে। ইসরায়েলের হামলার প্রতিটি জবাব আমরা দেব, এবং এই প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হবে।”
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত কেবল দুই দেশের মধ্যকার লড়াই নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধ যদি পূর্ণ মাত্রায় রূপ নেয়, তবে সিরিয়া, লেবানন, হিজবুল্লাহ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক পক্ষ জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে পুরো অঞ্চল এক ভয়াবহ সংঘর্ষের দিকে গড়িয়ে পড়বে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইতোমধ্যেই দুই পক্ষকে “সংযম প্রদর্শনের” আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “এই মুহূর্তে আরও উত্তেজনা নয়, প্রয়োজন শান্তি ও আলোচনার পথ খোলা রাখা।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বহু বছর ধরে চলে আসা ‘ছায়া যুদ্ধ’ এখন আর গোপন নেই। এটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জলসীমা থেকে শুরু করে গাজা ও লেবানন সীমান্ত, এমনকি আরব উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এই সংঘাত।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং উভয় পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ইসরাইল ও ইরান উভয়েই যে এখন নিজেদের অবস্থানে অনড় এবং চূড়ান্ত জবাব দিতে প্রস্তুত—তা তাদের সাম্প্রতিক ভাষ্য ও কার্যক্রমেই স্পষ্ট।
বর্তমানে ইরান ও ইসরাইল এক ভয়াবহ সংঘাতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুই দেশ একে অপরকে সামরিক শক্তি দিয়ে জবাব দিতে প্রস্তুত, এবং এর মাঝখানে সাধারণ জনগণ অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এ যুদ্ধ কতটা বিস্তৃত হবে, কে আগে আঘাত করবে এবং কে আগে পিছু হটবে—তা এখনো অনিশ্চিত। তবে এটুকু স্পষ্ট, তেহরান ও তেল আবিবের আকাশের গর্জন বিশ্ব রাজনীতিকে নতুন করে এক সংকটময় মোড়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ