
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক রূপান্তরে এক ঐতিহাসিক অধ্যায় যোগ হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহুল আলোচিত বৈঠকের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠককে জাতির ভবিষ্যতের মোড় ঘোরানো সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
শুক্রবার (১৩ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক দীর্ঘ বিবৃতিতে শফিকুল আলম বলেন, “অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হিসেবে একটি অনন্য মাইলফলক। এ বৈঠক ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য কফিনে শেষ পেরেক।”
শফিকুল আলম দাবি করেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী কাঠামোর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, “এটি ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য গেম ওভার মুহূর্ত। যারা এতদিন দেশকে অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল, তাদের সব হিসাব-নিকাশ ভেস্তে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আর কোনো বিদেশি লবিস্ট, গোপন অর্থনৈতিক চুক্তি কিংবা কূটনৈতিক চক্রান্ত দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। কারণ দেশ এখন নেতৃত্বের এক অভূতপূর্ব ঐক্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধীনে।”
বৈঠকের প্রসঙ্গ ছাড়াও শফিকুল আলম তার বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের নানা অর্জনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, অধ্যাপক ইউনূস রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে এক সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। সেই সঙ্গে রাজা চার্লসের সঙ্গে একান্তে ৩০ মিনিটব্যাপী একটি সৌজন্য সাক্ষাৎও অনুষ্ঠিত হয়।
প্রেস সচিব বলেন, “এই পুরস্কার ও বৈঠক শুধু ব্যক্তি ইউনূসের আন্তর্জাতিক মর্যাদার স্বীকৃতি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তরণ, বিশেষ করে গত বছরের জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন ধারার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।”
তিনি এটিকে "জুলাই বিপ্লবের পূর্ণতা" হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, “এই অর্জন বাংলাদেশকে একটি নতুন কূটনৈতিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এটি ভবিষ্যতে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় বড় ধরনের কূটনৈতিক পুঁজি হয়ে উঠবে।”
শফিকুল আলমের বিবৃতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ইতোমধ্যে সাবেক ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ নেতার ৩২০টি অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করেছে যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, “এনসিএ নিজেই জানিয়েছে এটি তাদের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বড় সম্পত্তি জব্দের ঘটনা। এটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক এবং বিশ্বে আমাদের সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের শক্ত বার্তা।”
প্রেস সচিব জানান, এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন আইনপ্রণেতা, মন্ত্রী ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, “এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা কেবল টাকা নয়, আত্মবিশ্বাস এবং নৈতিক কর্তৃত্বও পুনরুদ্ধার করছি।”
শফিকুল আলম তাঁর পোস্টে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক মহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের মানবিক অবস্থান এবং এই সংকট নিরসনে অধ্যাপক ইউনূসের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্য সফরের সময় একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, এই সংকটের টেকসই সমাধানে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়।”
বিবৃতিতে স্পষ্ট বার্তায় শফিকুল আলম বলেন, “এই অর্জন শুধু বর্তমান সরকারের নয়, বরং এটি প্রতিটি দুর্নীতিবাজের জন্য সতর্কবার্তা। আপনি যত বড় প্রভাবশালীই হোন না কেন, আইন ও আন্তর্জাতিক বিধান থেকে আপনি পালাতে পারবেন না।”
তিনি আরও বলেন, “সম্পদ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি শুধু যুক্তরাজ্য নয়, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হবে। আমাদের কূটনীতিক, গোয়েন্দা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে সেসব দেশের সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে।”
বিবৃতির শেষাংশে প্রেস সচিব আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার এই সফর শুধু অতীতের হিসাব চুকানো নয়, এটি ভবিষ্যতের পথচিত্র নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আশা করি, এই অভিজ্ঞতা আমরা আন্তর্জাতিক মঞ্চেও কাজে লাগাতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়, স্বচ্ছতা চায়, জবাবদিহি চায়। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে সেই পরিবর্তনের ভিত্তি ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। এখন সময় তা আরও গভীর ও স্থায়ী করার।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ