
ছবি: সংগৃহীত
একদিকে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ঘিরে সতর্কবার্তা, অন্যদিকে ডেঙ্গুর লাগামছাড়া সংক্রমণ—দুই দিক থেকেই যেন মৃত্যু ও রোগের আশঙ্কায় কাটছে বাংলাদেশের মানুষের দিন। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা, বেড়েছে মৃত্যুও। স্বাস্থ্য বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে চলতি বছর ডেঙ্গু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ (১৩ জুন) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৫৭০ জন। তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বরিশাল বিভাগের। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে—যার মধ্যে ৪ জন বরগুনার, ১ জন ঢাকার। নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ১৫৯ জন, যার মধ্যে ১২৪ জনই বরিশাল বিভাগের। শুধু বরগুনাতেই ৬৭ জন নতুন করে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। এতে জেলার পরিস্থিতিকে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
রাজধানীকেন্দ্রিকতা হারিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম ও জেলা শহরে
দীর্ঘদিন ধরেই ডেঙ্গুকে রাজধানীকেন্দ্রিক সমস্যা হিসেবে দেখা হলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। এখন আর ডেঙ্গু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যে এডিস মশা ৫৮টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বরগুনার মতো দক্ষিণাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত জেলার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ডেঙ্গুর ছড়িয়ে পড়ার গতিপ্রকৃতির একটি বিপজ্জনক ইঙ্গিত।
মৃত্যুহার বেশি ঢাকায়, আক্রান্ত বেশি বরিশাল বিভাগে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, চলতি বছরে মোট মৃত্যু ২৮ জন। যদিও আক্রান্তের সংখ্যা বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি, তবে মৃত্যুহারের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে ঢাকা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকার অনেক হাসপাতাল ও এলাকা এখনো পর্যাপ্ত মশানিধন কার্যক্রমের আওতায় না আসায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগে সংক্রমণ বেশি হলেও কিছু এলাকায় জনসচেতনতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো থাকায় মৃত্যুর হার এখনও কিছুটা কম।
কেন ভয়াবহ হতে পারে এবারের পরিস্থিতি?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, “এখনো ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়নি। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে, পানি জমে থাকবে, এডিস মশা বিস্তার ঘটাবে—তখন প্রকৃত মৌসুম শুরু হবে। আগামী মাস এবং তার পরের মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও অনেক বাড়বে। যদি এখনই লাগাম টেনে ধরা না যায়, তাহলে বরগুনা ছাড়াও আরও অন্তত ১০-১২টি জেলায় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এই রোগ।”
তিনি আরও বলেন, “বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পরিস্থিতি খারাপ হতে যাচ্ছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। এসব এলাকায় পর্যটনের কারণে মানুষের চলাচল বেশি, ফলে দ্রুত ছড়ায়। এখন থেকেই স্থানীয় প্রশাসনকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।”
চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ডেঙ্গু রোগী সামলানোর প্রস্তুতি এখনও পর্যাপ্ত নয়। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের আগে কিছু প্রস্তুতি থাকলেও জেলাভিত্তিক হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় বেড, প্লাটিলেট পরীক্ষার সরঞ্জাম, জরুরি ওয়ার্ড ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক সংকট প্রকট আকারে দেখা দেয়। বিশেষ করে বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুরের মতো জেলাগুলোতে রোগী বেড়ে গেলে সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
প্রতিরোধই প্রধান উপায়—বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর কোনো প্রতিষেধক না থাকায় প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। মশার বিস্তার বন্ধ করতে না পারলে কোনো হাসপাতালই রোগী সামলাতে পারবে না। তাই সচেতনতা এবং কার্যকর মশানিধনই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, “যে বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে, সেই বাড়ির চারপাশের ২০০ মিটার এলাকায় ফগিং করতে হবে। শুধু রোগীর চিকিৎসা করলেই হবে না, আশপাশের মশা নির্মূল না করতে পারলে রোগ বাড়তেই থাকবে। পাশাপাশি জমে থাকা পানি, ফুলদানি, ড্রাম, নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে পড়ে থাকা সামগ্রী পরিষ্কার রাখতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “মশা নিধন কার্যক্রম ঢাকায় যতটা আছে, অন্যান্য জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে সেটা নেই বললেই চলে। এটা এখনই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন, পৌরসভাগুলোর দায়িত্ব এখানে সবচেয়ে বেশি।”
সার্বিক পরিস্থিতি
মোট আক্রান্ত (২০২৫) | ৫,৫৭০ জন |
---|---|
মোট মৃত্যু | ২৮ জন |
আক্রান্তের শীর্ষ বিভাগ | বরিশাল |
মৃত্যুহারে শীর্ষে | ঢাকা |
সর্বোচ্চ সংক্রমিত জেলা | বরগুনা (রেড জোন) |
ডেঙ্গুর এই লাগামছাড়া সংক্রমণ ঠেকাতে না পারলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আবারও এক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। অতএব, এখনই জরুরি ভিত্তিতে মশানিধন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাসপাতালসমূহে প্রস্তুতি জোরদার করা না হলে, সামনে আরও অনেক মৃত্যু এবং বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ