
ছবি: সংগৃহীত
ভারতসহ পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু দেশে আবারও বাড়তে শুরু করেছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। বিশেষ করে ভাইরাসটির নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্টগুলো নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। যদিও বাংলাদেশে এখনও বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি, তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, যেহেতু কোভিড-১৯ এখনো নির্মূল হয়নি এবং ভাইরাসটি রূপ পরিবর্তন করে টিকে আছে, তাই একে অবহেলা করলে ভবিষ্যতে আবারও বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে করোনার যে নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, তা আগের তুলনায় দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। যদিও নতুন এই ধরনটি এখন পর্যন্ত মারাত্মক প্রাণঘাতী নয় বলে জানানো হয়েছে, তবুও উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতার কারণে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে বয়স্ক, অসুস্থ ও দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় ভোগা মানুষ।
বাংলাদেশে সতর্কবার্তা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও পরিস্থিতি বিবেচনায় জনসাধারণকে সর্বোচ্চ সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শপিং মল এবং ধর্মীয় স্থানে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সরকারি নির্দেশনায় মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া এবং হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
নিম্নে করোনা সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিশেষজ্ঞদের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ করণীয়গুলো তুলে ধরা হলো:
সাধারণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. মাস্ক ব্যবহার করুন
বিশেষ করে বদ্ধ, জনসমাগমপূর্ণ এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাস্ক ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। যারা হাসপাতালে যাওয়া-আসা করেন, তাদের জন্য মাস্ক বাধ্যতামূলক। এন-৯৫ বা ট্রিপল লেয়ার মাস্ক বেশি কার্যকর বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন।
২. হাঁচি ও কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন
হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ও নাক ঢাকতে টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করুন। টিস্যু ব্যবহারের পর তা নিরাপদে ফেলুন এবং হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
৩. নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
বাইরের যেকোনো কিছু স্পর্শ করার পর, খাবার খাওয়ার আগে বা পরে, বাথরুম ব্যবহারের পরে হাত ধুতে হবে। কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাইরে থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
৪. শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন
কমপক্ষে ৩ ফুট বা ১ মিটার দূরত্ব রাখার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বিশেষ করে যখন কেউ কাশছে বা হাঁচছে।
৫. জনসমাগম এড়িয়ে চলুন
বিশেষ করে যেখানে বাতাস চলাচল কম, সেসব স্থানে ভিড় এড়িয়ে চলা সবচেয়ে ভালো। বিপণি বিতান, স্টেশন, অফিস কক্ষ বা যে কোনো গণপরিবহণে সতর্ক থাকুন।
৬. অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন
জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ঘরে বিশ্রাম নিন এবং অন্যদের থেকে দূরে থাকুন। পরিস্থিতি গুরুতর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৭. উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করান
সর্দি-কাশি, স্বাদ-ঘ্রাণ চলে যাওয়া, ক্লান্তি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলেই কোভিড পরীক্ষা করান। নিজের পাশাপাশি অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
৮. বায়ুচলাচল নিশ্চিত করুন
বাসা, অফিস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জানালা খোলা রাখুন। সম্ভব হলে ফ্যান বা এক্সজস্ট ফ্যান ব্যবহার করুন।
টিকাকরণ এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অনুমোদিত কোভিড-১৯ টিকা এখনও কার্যকর এবং নিরাপদ। স্বাস্থ্য ঝুঁকি যাদের বেশি, যেমন—ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগে আক্রান্ত বা ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য বুস্টার ডোজও গুরুত্বপূর্ণ। যারা এখনো টিকা নেননি বা নির্দিষ্ট সময়ের পর বুস্টার গ্রহণ করেননি, তারা দ্রুত তা সম্পন্ন করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ফ্লু টিকার কথাও বলা হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। এটি শীত মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
সুস্থ জীবনযাপন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
১. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন: প্রতিদিন শাকসবজি, ফলমূল, ডাল এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার খান।
২. পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নিন: দিনে অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৩. ব্যায়াম করুন: নিয়মিত হালকা ব্যায়াম শরীর ও মন ভালো রাখতে সহায়তা করে।
৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন: এগুলো ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এবং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে।
মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখুন
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, হতাশা এবং মানসিক চাপ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া, সঙ্গীত শোনা বা ধ্যান করা মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়তা করে।
আন্তর্জাতিক ভ্রমণে সতর্কতা অবলম্বন করুন
১. ভারতের মতো আক্রান্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ এড়িয়ে চলুন, যদি না খুব জরুরি প্রয়োজন থাকে।
২. বিমানে ওঠার আগে ও পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
৩. দেশে ফেরার সময় বন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করুন। এখন থার্মাল স্ক্যানার, ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে।
আতঙ্ক নয়, সচেতন হোন
বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ বাড়লেও বাংলাদেশে এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে পরিস্থিতি। তবে আত্মতুষ্টি বিপজ্জনক হতে পারে। কোভিড মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো— সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং টিকাকরণ। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে আমরা নিজেদের এবং চারপাশের মানুষদের নিরাপদ রাখতে পারি।
স্মরণে রাখুন— সতর্কতা এখনই, সুরক্ষা চিরদিনের জন্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ