
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ঈদুল আজহা উদযাপন করেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়—কিন্তু তা কোনো উৎসবমুখর পারিবারিক আবহে নয়, বরং ছিল উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত একটি ‘সেফ হাউজ’-এ মা শেখ হাসিনার সঙ্গে সীমিত পরিসরের এক মিলন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ সময় পর এই প্রথম মা ও ছেলের দেখা হলো ভারতে। তবে তাদের এ পুনর্মিলন ও ঈদ উদযাপন ঘিরে এখন ব্যাপক আলোচনা চলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে। অনেকেই প্রকাশ্যে না বললেও এই ঈদ উদযাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ কেউ কষ্ট ও ক্ষোভও চেপে রাখতে পারছেন না।
জানা গেছে, জয় তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার পর সম্প্রতি মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসে অনুষ্ঠিত এক নাগরিকত্ব শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পান। এরপর তিনি মার্কিন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন এবং পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভারতে যান। ঈদুল আজহার আগের দিন শুক্রবার তিনি নয়াদিল্লিতে পৌঁছান, যেখানে তার মা শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে অবস্থান করছিলেন ভারতের সরকারি নিরাপত্তায় একটি সেফ হাউজে। সেখানেই অত্যন্ত গোপনীয় পরিবেশে মা-ছেলে ঈদ উদযাপন করেন।
তবে জয় ভারতে গেলেও সেখানে তিনি কোনো রাজনৈতিক সভা, আলোচনায় অংশ নেননি এবং দলীয় নেতাদের সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎ হয়নি। কলকাতাতেও তার যাওয়ার পরিকল্পনা নেই বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। ভারত সফর শেষে তিনি শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবেন বলেও নিশ্চিত করেছে দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
মা-ছেলের এমন ঈদ উদযাপন যে একান্ত পারিবারিক, তা যদিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার বলছেন, তবুও পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন কথা বলছে। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে একাধিক মাঝারি ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী তাদের হতাশা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, “আমরা মেনে নিচ্ছি—সন্তান মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে পারে। এটা মানবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ জেলে, কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউ পাসপোর্ট বাতিল হয়ে দেশেই নেই। এই দুঃসময়ে দলের নেতা যদি দলকে বার্তা দিতে চাইতেন, তাহলে তিনি ঈদ না করার ঘোষণা দিয়েই নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে পারতেন।”
আরেকজন জেলা পর্যায়ের নেতা বলেন, “দল এখন নিষিদ্ধ, নেত্রী দেশছাড়া, আমাদের কেউ খোঁজ নেয় না। নেত্রী, তার ছেলে, মেয়ে—সবাই নিরাপদে আছেন, সরকারের নিরাপত্তায়। আর আমাদের পরিবারগুলো মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। এই বৈষম্য আগেও ছিল, এখনও আছে।”
তারা আরও বলেন, “যখনই দল বিপদে পড়ে, তখন আমরা সাধারণ কর্মীরাই রাস্তায় নামি, জেল খাটি, পেট খালি রেখে হাটে-মাঠে থাকি। কিন্তু দল যখন সুসময় পায়, তখন শীর্ষ পর্যায়ের সবাই বিদেশে, পরিবারসহ সুখে-শান্তিতে। এই চক্র থেকে যেন বের হওয়া যাচ্ছে না।”
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার ভাষ্য অনুযায়ী, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঢাকায় ফিরে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার মূল কারণ ছিল তার নাগরিকত্ব সংক্রান্ত জটিলতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল করে দেওয়া হয়, ফলে দেশে ফিরতে আর কোনো বৈধতা ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্তও এক ধরনের ‘কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন’, যা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, নেতৃত্ব বা সম্ভাব্য পুনর্গঠনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। যদিও দলের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করে বলা হচ্ছে—জয়ের এই সফর পুরোপুরি পারিবারিক এবং এতে রাজনৈতিক কোনো বার্তা নেই।
ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, সজীব ওয়াজেদ জয়কে ভারতে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভিভিআইপি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তবে তার নিরাপত্তা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। বিমানবন্দর থেকে তাকে গাড়িবহরে করে সেফ হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনার মেয়ে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ দিল্লিতেই অবস্থান করলেও তার সঙ্গে জয়ের সাক্ষাৎ হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এক আওয়ামী লীগ নেতা মন্তব্য করেন, “মা-ছেলের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, সেটা এখনো অজানা। তবে রাজনীতি, দলের ভবিষ্যৎ—এসব নিয়ে আলোচনা হয়নি, এমনটা ভাবাও কঠিন। কিন্তু তারা হয়তো এখনো প্রকাশ্য বার্তা দিতে চান না। সবকিছু পর্যবেক্ষণের মধ্যেই রেখেছেন।”
দলটির এক সিনিয়র নেতা বলেন, “দলীয় সভা হয়নি, ভারতে আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে জয়ের সাক্ষাৎ হয়নি—এই তথ্যে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বর্তমান বাস্তবতায় সবই গোপনে, পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। যখন সময় হবে, তখনই তা প্রকাশ পাবে।”
সজীব ওয়াজেদ জয়ের মার্কিন পাসপোর্ট গ্রহণ, দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গী হওয়া এবং রাজনৈতিক স্তরে ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকলেও উপস্থিত থাকা—সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনীতির সম্ভাব্য নকশা আঁকার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মহল।
যদিও দলটি আপাতত চুপচাপ, তবুও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই ঈদটা ছিল শুধু ঈদ নয়—এটি ছিল রাজনৈতিক নিঃশব্দতা ভেদ করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে একটি পুনর্গঠনের সূচনা বা অন্তত সংকেত।”
এদিকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ অনেক নেতা মনে করেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে জয়ের এই ঈদ উদযাপন দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের হতাশ করলেও এটিই ভবিষ্যতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভিত্তি হতে পারে। তবে সাধারণ নেতাকর্মীদের ক্ষোভ না প্রশমিত করে দলের পুনর্গঠন সম্ভব নয় বলেও তারা মন্তব্য করেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ