
ছবি: সংগৃহীত
কাতারের আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের যুক্তরাজ্যে থাকা বিস্তীর্ণ সম্পদ জব্দ করেছে ব্রিটেনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের অনুরোধ ও আইনগত আবেদন পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ একজন রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী ব্যক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছেন। তিনি ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে অবস্থান করে আসছেন। কিন্তু গত কিছু বছর ধরে তার বিরুদ্ধে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, যার মধ্যে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগ।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি অর্থনৈতিক অপরাধ ও পাচারের মামলায় সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ‘ফ্রিজিং অর্ডার’ জারি করেছে, যার অর্থ তিনি আর তার সম্পত্তি বিক্রি, স্থানান্তর বা অন্য কোনো ব্যবসা করতে পারবেন না। এই তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে এবং এর পরিধি ও বিস্তার ক্রমেই বাড়ছে বলে জানা গেছে।
আল জাজিরার অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩৫০টির বেশি সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে। এসবের মধ্যে বিশেষ করে লন্ডনের সেন্ট জনস উড এলাকার একটি বিলাসবহুল বাড়ি বর্তমানে তদন্তের আওতায় এবং সেটি জব্দের প্রস্তুতি চলছে। ১১ মিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮১ কোটি টাকার বেশি) মূল্যের এই সম্পত্তির কিছু অংশ আল জাজিরার গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে, যা প্রকাশ করা হয়েছে।
এই সময়ে, যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনে রয়েছেন এবং দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলছেন, ঠিক তখনই এই ধরণের বড় ধরনের আন্তর্জাতিক তদন্ত ও সম্পত্তি জব্দের খবর প্রকাশিত হওয়া বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
এনসিএর একজন মুখপাত্র আই-ইউনিটকে জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপ একটি চলমান দেওয়ানি তদন্তের অংশ। তারা নিশ্চিত করেছেন যে, বেশ কয়েকটি সম্পত্তি জব্দের আদেশ পেয়েছে এবং এসব সম্পত্তি থেকে অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এর আগে বাংলাদেশের একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, সাইফুজ্জামানের ৩৯টি ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাবসহ তার সমস্ত আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কারণ তার বিরুদ্ধে রয়েছে কোটি কোটি টাকার ঋণ ও ব্যবসায়িক অনিয়মের অভিযোগ। এর মধ্যে রয়েছে একটি কাগুজে কোম্পানির মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও, যা দেশীয় তদন্ত সংস্থাগুলো অনুসন্ধান করছে।
সাইফুজ্জামান নিজেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বিশ্বের নানা দেশে তার বিশাল সম্পত্তির কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তার ব্যবসা লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে এবং সে বিষয় শেখ হাসিনারও ভালো জানা রয়েছে। একবার তিনি সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করেন, ‘আমি আসলে শেখ হাসিনার ছেলের মতো, এবং তিনি আমার ব্যবসা সম্পর্কে অবগত আছেন।’
ব্রিটেনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি, যা সাধারণত ‘ব্রিটেনের এফবিআই’ নামে পরিচিত, তার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা ও আর্থিক জালিয়াতি মোকাবেলায় দেশের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের প্রমাণ। এর ফলে বাংলাদেশের অবৈধ সম্পদ পরিমাণ সীমিতকরণ ও আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এলাকা বিশেষজ্ঞ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের সম্পদ জব্দ এবং তদন্ত দেশের অর্থনৈতিক শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একই সঙ্গে, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের স্বচ্ছতা ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সুদৃঢ় করবে।
বর্তমানে সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ওঠেছে তার তদন্ত যথাযথভাবে শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ করছে। তবে সম্পত্তি জব্দ ও ব্যাংক হিসাব জব্দের ফলে তার আর্থিক ক্ষমতা সীমিত হয়ে এসেছে। এই পদক্ষেপগুলো আগামী দিনের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যাতে অবৈধ অর্থায়ন ও সম্পদ শোষণকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর আইন প্রয়োগ সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের জনগণও এই ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আইনগত পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং আশা করছে দেশের রাজনীতিতে আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
সার্বিকভাবে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিপুল সম্পত্তি জব্দ এবং চলমান তদন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শুদ্ধিকরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এই প্রক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত এবং জবাবদিহিমূলক করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ