
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর একের পর এক বর্বর হামলা যেন আর কোনো ন্যূনতম মানবিক সীমা মানছে না। সর্বশেষ বুধবার (১১ জুন) মধ্য গাজার ‘নেতজারিম করিডর’ ও দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফা এলাকায় দুটি পৃথক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে চালানো নৃশংস হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪০ জন ক্ষুধার্ত ও অসহায় ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ২০০ জন।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি ও কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এমন সময়, যখন তীব্র খাদ্য সংকটে বিপর্যস্ত হাজার হাজার ফিলিস্তিনি রাতভর দাঁড়িয়ে ছিলেন ত্রাণ সংগ্রহের আশায়। বিতর্কিত 'গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন' বা জিএইচএফ–এর পরিচালনায় পরিচালিত কেন্দ্রগুলোতে এই ত্রাণ বিতরণ চলছিল, যেটি সমর্থন করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ ‘সিভিল ডিফেন্স’-এর মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, রাত ২টা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল–সমর্থিত ত্রাণকেন্দ্রের কাছে জড়ো হতে থাকেন হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ। ফজরের আগে, ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ ট্যাংক ও ড্রোন হামলার মাত্রা বাড়ানো হয়।
তিনি বলেন, “নেতজারিম করিডরে খাবারের আশায় জড়ো হওয়া কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিকের ওপর ইসরাইলি সেনারা সরাসরি ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ ও ড্রোন হামলা চালায়। আমরা অন্তত ৩১ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছি। গুরুতর আহতদের সংখ্যা প্রায় ২০০।”
এই হামলার ফলে ত্রাণ সংগ্রহে আসা শিশু, নারী, ও বৃদ্ধসহ শত শত মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে ছিটকে পড়ে। অনেকেই ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান, আর বাকি আহতদের নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন অস্থায়ী হাসপাতাল ও চিকিৎসা ক্যাম্পে।
এদিকে একইদিন, গাজার দক্ষিণাঞ্চল রাফা শহরের নিকটবর্তী আরেক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে গুলিবর্ষণে আরও ৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্থানীয় হাসপাতাল নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে আলজাজিরা।
এমন ভয়াবহ হামলার পর ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতি দিয়েছে বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামে। তারা দাবি করেছে, নেতজারিম করিডরে তাদের সেনারা রাতে ‘সতর্কতামূলক গুলি’ চালিয়েছে। তবে এটি যে সরাসরি বেসামরিক লোকদের ওপর চালানো নিছক হত্যাযজ্ঞ ছিল, সেটি প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিডিও, আহতদের বিবরণ এবং উদ্ধারকর্মীদের বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এ নিয়ে বিতর্কিত জিএইচএফ-এর বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নিতে গিয়ে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দেড় শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। এই সংস্থাটির কার্যক্রম ঘিরে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে, কারণ এটি এমন এক ত্রাণ কাঠামো যার নেপথ্যে রয়েছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অর্থায়ন ও নিয়ন্ত্রণ। বহু ফিলিস্তিনি এই সংস্থাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছেন। তাদের অভিযোগ, এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে একদিকে মানুষকে নির্ভরশীল করা হচ্ছে, অন্যদিকে সুবিধাজনক সময় ও স্থানে হত্যার টার্গেট বানানো হচ্ছে।
এই হামলার প্রেক্ষাপটে নতুন করে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবির এক বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য মুসলিম দেশগুলোর উচিত নিজেদের কিছু জমি ছেড়ে দেওয়া। ইসরাইলের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের চেয়ে মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে ৬৪৪ গুণ বেশি জমি।”
এই বক্তব্যে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বহু বিশ্লেষক মনে করছেন, মার্কিন প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের এই বক্তব্য আসলে একটি পরিকল্পিত কৌশলের অংশ—যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ইসরাইলের ভূখণ্ড থেকে সরিয়ে অন্যত্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করা হচ্ছে।
মাইক হাকাবি দীর্ঘদিন ধরেই কট্টর ইহুদিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী। তিনি ‘গ্রেটার ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে বাইবেলের পরিভাষা ‘জুদিয়া ও সামারিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ ধরনের রূঢ় কূটনৈতিক মন্তব্য ফিলিস্তিনিদের জন্য যেমন অপমানজনক, তেমনি শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও দূরে সরিয়ে দেয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
গাজার পরিস্থিতি এখন এক ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নিয়েছে। যুদ্ধের পাশাপাশি ত্রাণ সংগ্রহেও জীবন যাচ্ছে মানুষের। সীমান্ত অবরোধ, হাসপাতাল ধ্বংস, পানির সংকট, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা—সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।
বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়েও ইসরাইল যে প্রতিনিয়ত যুদ্ধাপরাধের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তা এই হামলা আরও একবার প্রমাণ করল। অবরুদ্ধ গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ত্রাণ ছিল জীবনের শেষ আশ্রয়। কিন্তু সেই আশ্রয়ও এখন একেকটি মৃত্যুফাঁদ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এই ঘটনার তদন্ত ও বিচার চেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একাংশ এখনও ইসরাইলকেই আত্মরক্ষার বৈধতা দিয়ে চলেছে।
একদিকে যখন গাজা ভূখণ্ডে ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও রোগে জর্জরিত মানুষ একমুঠো খাবারের আশায় ত্রাণকেন্দ্রে যাচ্ছেন, তখন অন্যদিকে ইসরাইলি সেনারা সেসব কেন্দ্রকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে একের পর এক নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে। এটি আর নিছক সংঘর্ষ নয়—এটি একটি পূর্ণমাত্রার মানবতাবিরোধী অপরাধ। বিশ্ব বিবেক এখনই না জাগলে, আগামী দিনের ইতিহাসে এই নিষ্ক্রিয়তা হবে সভ্যতার অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ