
ছবি: সংগৃহীত
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি একটি বক্তব্য প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি সরকারের কাজ নিয়ে তার ওপর চলমান সমালোচনা ও নিন্দাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করলে আমাকে করা হয়, তাহলে ভালো কাজের প্রশংসাও কেন আমার হবে না?” তিনি আরও সতর্ক করেছেন, “আল্লাহ আছেন, আমাদের সবাইকে একদিন জবাব দিতে হবে।” এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি নিন্দুকদের সতর্ক করার পাশাপাশি নিজ ও তার মন্ত্রণালয়ের কাজের প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করেছেন।
গত কয়েক দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ন সংক্রান্ত একটি ভুল সংবাদ প্রকাশের পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এর ফলে নিন্দার আঘাত পড়ে আসিফ নজরুলের পরিবারের ওপরও। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে এমন আইন করা হলো তার মন্ত্রণালয়ে। অন্যদিকে সমালোচকরা দাবি করেছেন, এই কাজ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের নাম স্পষ্টতই ওই আইনটিতে রয়েছে। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আসিফ নজরুল তার ফেসবুক পোস্টে বিস্তারিত জানিয়েছেন, আইন মন্ত্রণালয় সরাসরি আইন প্রণয়ন করে শুধুমাত্র তার নিজস্ব দায়িত্বভূক্ত বিষয় যেমন দেওয়ানি কার্যবিধির সংশোধনী আইন বা উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন। অন্য যেকোনো মন্ত্রণালয়ের অধীন যে আইন বা অধ্যাদেশ হয়, তা প্রথমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তৈরি করে এবং পরে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা হয়। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যা ‘রুলস অফ বিজনেস’ অনুসারে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে প্রচলিত।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, এনবিআর সম্পর্কিত অধ্যাদেশ অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করেছে, তবে তা আইন মন্ত্রণালয়কে জারি করতে হয়। একইভাবে, সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বিধির অধ্যাদেশ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করেছে, কিন্তু সেটিও আইন মন্ত্রণালয় জারি করেছে। অর্থাৎ, আইন মন্ত্রণালয় আইনগুলোর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে না, শুধুমাত্র তা জারি করার কর্তৃপক্ষ।
আসিফ নজরুল এও বলেন, কখনো কখনো সমাজে এমন মানুষও আছেন, যাদের নিন্দা করা আর কুৎসা রটানোই প্রিয় সাধ। তারা অন্য কাউকে কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে নিজের আনন্দ খুঁজে পান। তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন, বিশেষ করে যারা নিন্দা করেন, তাদের উচিত আগে বিষয়গুলো ভালোভাবে জানা। কারণ, সরকারের কোনো কাজের দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে সরকারের হলেও নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে যিনি দায়িত্বে আছেন, তার কাজের জন্যই তাকে দায়ী করা উচিত।
তিনি নিজেও একাধিকবার অসত্য অভিযোগের শিকার হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় যেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায় ছিল, তবুও তাঁকে দায়ী করা হয়েছে। আবার দ্রব্যমূল্য স্থির রাখার প্রশংসাও তাকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, যা বাস্তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “সরকারের যে কোনো কাজের জন্য নিন্দা বা প্রশংসা যদি আমাকে করা হয়, তাহলে অন্যদের কাজের জন্য অন্যদের দেওয়া উচিত।” এই কথায় তিনি স্পষ্ট করেছেন, কাজের দায়িত্বের সঠিক ভাগাভাগি না করলে বিভ্রান্তি ও অবিচার সৃষ্টি হয়।
তাঁর কথায়, যারা নিন্দা করেন, তারা হয়তো নিজের কষ্ট অন্যকে বুঝতে পারেন না। এটি অন্য কাউকে যন্ত্রণায় ফেলতে পারে, যা নিজের পক্ষে বরদাশত করা কঠিন। তাই তিনি আবারো বলছেন, নিন্দা করার আগে একটু ভেবে দেখে নিন বিষয়গুলো, কারণ আল্লাহ আছেন এবং সবাইকে একদিন জবাব দিতে হবে।
আসিফ নজরুলের বক্তব্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্য ও অসত্য অভিযোগের নেতিবাচক প্রভাব। বিশেষ করে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ কেবল ব্যক্তিগত জীবন ও সম্মান ক্ষুণ্ন করে না, বরং সরকারের ভাবমূর্তি ও কাজের ধারাবাহিকতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই তিনি নিন্দুক ও সমালোচকদের মূর্খতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
আইন উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন যে, সরকারের যেকোনো কাজের সামগ্রিক দায়িত্ব থাকে পুরো সরকারের ওপর। কিন্তু সেটি ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট কারো একক দায়িত্বরূপ নয়। তাই ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দায়ী করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধি বিবেচনা করা জরুরি।
সবশেষে আসিফ নজরুল উল্লেখ করেছেন, যে কোনো কর্মকাণ্ডে সকলের সামনে আল্লাহ সর্বদা আছেন এবং আমরা সবাইকে একদিন তার কাছে নিজের কাজের জন্য জবাব দিতে হবে। এই বিশ্বাস থেকে সবাই যেন দায়িত্বশীল, সতর্ক ও ন্যায়সঙ্গত হয়, সেজন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের এই বক্তব্য দেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, সরকারের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন ও সমালোচনার ক্ষেত্রে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে আলোচনা হওয়া উচিত। নিন্দা-বিচার করার আগে একটু জেনে-শুনে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে সমাজের সবাইকে আল্লাহর সামনে দায়বদ্ধতার কথা মনে রাখতে হবে।
এই বক্তব্য আধুনিক প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও পারস্পরিক সম্মানের মূলমন্ত্রকে তুলে ধরে, যা দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ