
ছবি: সংগৃহীত
ঢালিউডের পরিচিত মুখ, অভিনেত্রী তানিন সুবহা আর নেই। জীবনের মঞ্চ থেকে নীরবে নেমে গেলেন চিরতরে। মঙ্গলবার, ১০ জুন সন্ধ্যা ৭টা ৫৭ মিনিটে রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের ভাষায়, তিনি তখনই ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’। অর্থাৎ, তার শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কাজ করছিল না। তবে নীতিগতভাবে লাইফ সাপোর্ট সরাতে অপেক্ষা করা হচ্ছিল তার স্বামী রেজওয়ানের সম্মতির জন্য। সেই সম্মতি মেলে, এবং বিদায় জানানো হয় তানিনকে।
তানিনের এমন অকাল মৃত্যুতে শুধু চলচ্চিত্র অঙ্গনে নয়, সারাদেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তবে এই মৃত্যু ঘিরে রহস্য ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে তার মৃত্যুর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি আবেগময় ও বিভ্রান্তিকর ফেসবুক পোস্ট।
১৯ মে, মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগেই নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন তানিন সুবহা। সেখানে তিনি লেখেন, “কোনোদিন আমি তাবিজ বা কুফরিতে বিশ্বাস করতাম না। এখন করি। সুস্থ একটা মানুষকে এভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা করে কি লাভ? ঘরের আনাচে কানাচে কত কি যে পেলাম। কেন এমন করছেন! আমি তো কারো ক্ষতি করিনি।”
এই পোস্টটি অনেককেই কাঁপিয়ে দেয়। তিনি তার অসুস্থতার পেছনে রহস্যজনক কিছু ইঙ্গিত করেছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। লেখার ভঙ্গিতে হতাশা ও ভয়ের পাশাপাশি স্পষ্ট হয়েছে একপ্রকার অভিযোগ—কারো দ্বারা তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন, কিংবা কারো অশুভ প্রভাবে পড়ে যাচ্ছিলেন এমন সংকটে, যা কেবল শারীরিক নয়, মানসিকও।
পোস্টের শেষ অংশে তিনি আরও লেখেন, “শেষ চার মাস ধরে শুধু অসুস্থ আর অসুস্থ আমি। এসবের ফল পাবেন, চিন্তা কইরেন না। আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।”
এই অংশটিকে অনেকেই তার মৃত্যুর এক ধরনের পূর্বাভাস বা অন্তর্দৃষ্টি হিসেবে দেখছেন। মৃত্যুর আগে এমন অশুভ ইঙ্গিত, এমন রহস্যময় বার্তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
তানিন সুবহার সেই পোস্ট এখন নতুন করে ভাইরাল। মৃত্যুর সঙ্গে এই পোস্টের ‘যোগসূত্র’ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই গভীর উদ্বেগ আর কল্পনার আশ্রয় নিচ্ছেন। কারো কারো ধারণা, এটি হয়তো কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা, কারো করা কালো জাদু বা কুফরির আঘাতে সৃষ্টি হওয়া সংকটের প্রভাব।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “পোস্টের এক মাস না যেতেই চলে গেলেন। কতটা ভয়ঙ্কর ছিল পরিস্থিতি!”
আরেকজন লিখেছেন, “মৃত্যুর আগে নিজের কষ্টের কথা বলে গেছেন—এটাই প্রমাণ করে কালো জাদু কতটা বিষাক্ত।”
অপর এক নেটিজেন মন্তব্য করেছেন, “মানুষের মনে কতটা কষ্ট থাকলে এমনভাবে লিখে যেতে পারে। হয়তো সে আমাদের বলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি।”
গত ২ জুন হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তানিন সুবহাকে দ্রুত রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। সেখানে তাকে দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। শুরু হয় নিবিড় পর্যবেক্ষণ। চিকিৎসকরা জানান, তার শরীর দ্রুতই প্রতিক্রিয়া হারাতে শুরু করে। মাথার ভেতর সংক্রমণ, রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া এবং অন্যান্য কিছু জটিলতা একসঙ্গে দেখা দেয়। এই অবস্থায় লাইফ সাপোর্টই ছিল শেষ চেষ্টা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ এখনো প্রকাশ্যে আনা হয়নি, তবে তার স্বামী রেজওয়ান জানিয়েছেন, “আমরা ওর সবকিছু করছি শান্তির সঙ্গে শেষ করতে। ব্যক্তিগত কিছু বিষয় থাকলেও এখন তার আত্মার শান্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
তানিন সুবহা মডেলিং দিয়ে শোবিজে যাত্রা শুরু করেন। পরে ঢালিউডের কিছু ছবিতে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। অভিনয়ের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সরব উপস্থিতি ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে কিছু টানাপোড়েন থাকলেও পেশাগত দিক থেকে তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তানিন বেশ কিছু নাটক ও টেলিফিল্মেও অভিনয় করেছেন। তার হাসি, কণ্ঠ আর ক্যামেরার সামনে সাবলীল উপস্থিতি অনেক দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিল।
তানিন সুবহার মৃত্যু যেন একটি অসমাপ্ত গল্প। এক তরুণী শিল্পীর হঠাৎ অসুস্থতা, মৃত্যুর আগে অস্বাভাবিক বার্তা, হাসপাতালের বিছানায় টানা লড়াই এবং শেষপর্যন্ত স্বামীর সম্মতিতে লাইফ সাপোর্ট সরানো—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে অনুরাগীদের কাছে।
এ ঘটনা সামাজিকভাবে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিল্পীদের জীবন সবসময় যেমন রঙিন মনে হয়, বাস্তবতা অনেক সময় তার চেয়েও নির্মম হতে পারে। একজন অভিনেত্রীর কষ্ট, তার অপ্রকাশ্য অভিযোগ, আর সমাজের কিছু গা ছমছমে বিশ্বাস—সব মিলিয়ে এই মৃত্যু একটি অনতিক্রমযোগ্য রহস্যের আবরণে ঘেরা রইল।
তানিন সুবহার আত্মার শান্তি কামনা করে তার সহকর্মী, ভক্ত ও স্বজনরা বলছেন, “যে কষ্ট তিনি পেরিয়ে গেছেন, সেই কষ্টের বিচার যেন একমাত্র আল্লাহ করেন।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ