
ছবি: সংগৃহীত
চলতি জুন মাসের শেষদিকে চীন সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অন্তত দশজন সিনিয়র নেতা এই সফরে অংশ নেবেন। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে ২৪ জুন চীনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বে প্রতিনিধি দলটি। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিবেশে এই সফরটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও কৌশলগত গুরুত্ব বহন করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, চীনের ক্ষমতাসীন চায়না কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সরাসরি আমন্ত্রণেই বিএনপির এই সফর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সফরের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দলীয় পর্যায়ে—পার্টি টু পার্টি—সম্পর্ক আরও গভীর করা এবং দুই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। বিশেষ করে চীনের মতো পরাশক্তিধর একটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন বিএনপির কূটনৈতিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, “এর আগেও আমি চীন সফরে গিয়েছিলাম, তবে সেটি ছিল মাল্টি-পার্টি ডেলিগেশন। সেখানে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সাংবাদিকরা অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এবার এটি হবে শুধুমাত্র বিএনপির দলীয় প্রতিনিধি দল। এই সফরে আমাদের মহাসচিব নেতৃত্ব দেবেন এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ অংশ নেবেন। সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত হলে ২৪ জুনের আশেপাশে সফরটি বাস্তবায়িত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের রাজনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী, সেখানকার সরকার এবং ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় অভিন্নভাবে কাজ করে। ফলে চীন সফরে সরকার ও পার্টি উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক কূটনীতি উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
এই চীন সফরের কথা সামনে আসার সময়টিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী ১৭ জুন ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক নির্ধারিত আছে। এর কিছুদিন পরই দলের প্রতিনিধিরা চীন সফরে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বিএনপির একটি কৌশলগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা—যার মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে আন্তর্জাতিক মিত্রতা জোরদার করতে চাইছে। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে সহায়ক হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের নিয়মিত সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর আগে গত মাসের শেষ দিকে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্মেলনে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনে দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির প্রতিনিধি দল সেখানে চীনের নেতাদের সঙ্গে একাধিক আলোচনায় অংশ নেয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে মতবিনিময় করে।
এরও আগে ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত একটি মাল্টি-পার্টি সফরে বিএনপি প্রতিনিধিসহ সাতটি দলের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। সেই সফরে বিএনপির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন ড. আবদুল মঈন খান। এসব সফরের মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ধাপে ধাপে শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
চলতি সফরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধিদলের বৈঠকে বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিএনপির এই চীন সফর কেবলমাত্র সৌজন্যমূলক নয়, বরং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাপূর্ণ সময় চলছে। এই মুহূর্তে চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা বিএনপির আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শক্তিকে আরও মজবুত করবে। এছাড়া ভবিষ্যতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জনে এই সফরের ফলাফল বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীন দীর্ঘদিন ধরে একটি নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের চীন সফর অনেক তাৎপর্য বহন করছে। দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি সুসংগঠিত প্রতিনিধি দলের এই সফর শুধু পার্টি টু পার্টি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও নতুন যোগাযোগের দ্বার খুলে দিতে পারে। সবমিলিয়ে, রাজনৈতিক সংলাপ, কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ