
ছবি: সংগৃহীত
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন শর্করা নিয়ন্ত্রণহীন হলে তা হতে পারে এক ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে মা ও গর্ভের শিশুর উভয়ের জীবনযাত্রা ও সুস্থতায়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির পরেও, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করলে গর্ভাবস্থায় যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয় তা প্রাকৃতিক প্রসব ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। বিশেষ করে গর্ভধারণের শেষ কয়েক সপ্তাহে এই ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes Mellitus - GDM) হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে গর্ভবতী মায়েদের রক্তে গ্লুকোজ বা চিনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। অনেক সময় গর্ভাবস্থার আগে মায়ের ডায়াবেটিসের কোনও ইতিহাস না থাকলেও গর্ভের ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এর মূল কারণ হলো গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনগত পরিবর্তন, যা ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের সঠিক সময় ও পদ্ধতিতে চিকিৎসা না হলে তা মা ও শিশুর জন্য নানা জটিলতার জন্ম দিতে পারে। তাই গর্ভকালীন শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা খুবই জরুরি।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভের শিশুর ওজন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় ম্যাক্রোসোমিয়া (Macrosomia)। অর্থাৎ শিশুর দেহের ভর অনেক বেশি হওয়া। এই অবস্থায় সাধারণ ডেলিভারি সম্ভব হয় না, অনেক সময় সিজারিয়ান সেকশন করতে হয়। কারণ, বেশি ওজনের শিশুর ডেলিভারি জটিল হয়ে যায়, যার ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ে।
শিশুর ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যন্ত কমে যাওয়া খুব সাধারণ। এটি শিশুর জন্য মারাত্মক হতে পারে, কারণ এতে শিশুর মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। এছাড়া, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণহীন হলে শিশুর নানা উন্নয়নগত জটিলতা ও শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মায়ের জন্যও গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস অনেক ঝুঁকি তৈরি করে। গর্ভাশয়ে পানির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেলে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় অ্যামনিওটিক ফ্লুইড (Amniotic Fluid), তখন এই অবস্থা পলি হাইড্রোমিনিয়াস (Polyhydramnious) নামে পরিচিত। এর ফলে মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, একলাম্পসিয়া বা গর্ভকালীন খিঁচুনি হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে। এসব অবস্থায় মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে, তাই তত্ক্ষণাত্ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য সাধারণত একটি বিশেষ ধরনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়, যাকে বলা হয় ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT)। এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে করা হয়। পরীক্ষার আগে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কিছু খাওয়া-দাওয়া বাদ দিতে হয়। এরপর প্রথমে রক্তের নমুনা নেওয়া হয়, পরে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার গ্লুকোজ পান করানো হয় এবং দুই ঘণ্টা পর আবার রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
এই পরীক্ষায় যদি প্লাজমা গ্লুকোজের মাত্রা ৫.৬ মিমোল/লিটার বা তার বেশি এবং দুই ঘণ্টার পর ৭.৮ মিমোল/লিটার বা তার বেশি হয়, তবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট, ওষুধ বা ইনসুলিন থেরাপি দেওয়া হয়। এছাড়া নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও রক্তে শর্করার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারণে মাতৃ ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষত গর্ভাবস্থার শেষ ৪-৮ সপ্তাহ শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায় যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকে। তাই গর্ভবতী মায়েদের উচিত নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো ও চিকিৎসা গ্রহণ করা।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। কারণ মাতৃ ও শিশুর সুস্থ্য জীবন নিশ্চিত করতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ