
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইসরাইলের সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে। শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে ইরানের একাধিক সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইল ব্যাপক হামলা চালায়। এই হামলায় বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। হামলার মাত্রা ও এর পরিণতি নিয়ে গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
রয়টার্স, এএফপি এবং তাস নিউজসহ একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে, ইসরাইলের এই বিমান হামলায় আইআরজিসি-র একটি কৌশলগত ঘাঁটি, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র এবং সামরিক স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। রুশ সংবাদমাধ্যমের দাবি, হামলায় বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধানসহ কমপক্ষে ২০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘এই অপরাধের উপযুক্ত জবাব ইসরাইলকে অনুতপ্ত করবে। ইরানি জাতি কখনও এ ধরনের বর্বর আগ্রাসনের কাছে মাথানত করবে না। ইসরাইলকে এর মূল্য চুকাতেই হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সংঘাত থামানো জরুরি। ইরান যাতে পরমাণু বোমা অর্জন না করে, সে জন্য আমাদের নীতিগতভাবে কঠোর থাকা দরকার, কিন্তু সামরিক উত্তেজনা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।’ ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা আলোচনার টেবিলে ফিরতে চাই, যাতে নতুন করে চুক্তি করে স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো যায়।’
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস দুই দেশকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই সংঘাত আরও তীব্র হলে তা কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষ করে, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।’
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘ইসরাইলের এই একতরফা সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। এটি স্পষ্ট উসকানি, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করতে পারে।’ রাশিয়ার তেলআবিব দূতাবাস দেশটিতে অবস্থানরত রুশ নাগরিকদের ইসরাইল ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘এই ধরনের হামলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমরা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কায়া কাল্লাস বলেন, ‘বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও উদ্বেগজনক। সব পক্ষের উচিত উত্তেজনা না বাড়িয়ে দ্রুত কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘ইসরাইল ও ইরান—দুই দেশকেই সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বন করতে হবে। সংঘাতের এই ধারা যদি চলতে থাকে, তাহলে তা গোটা অঞ্চলের জন্য ধ্বংসাত্মক হবে।’
জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা কূটনৈতিক সব চ্যানেল ব্যবহার করে এই সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। ইরান যেন পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, সে লক্ষ্যেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও একই সুরে বলেন, ‘এই সংঘাত বন্ধ না হলে তা সবার জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে। শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলেন, ‘ইসরাইলের এই হামলা আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও মানবিক মূল্যবোধকে লঙ্ঘন করেছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এখনই এই দস্যুতার প্রতিবাদ জানানো।’
ওমান, যেটি দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দ্বন্দ্বে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে আসছে, জানায়—‘এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত একযোগে একটি স্পষ্ট ও কার্যকর বার্তা দেওয়া।’
কাতার এক বিবৃতিতে ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের ‘তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ’ জানায় এবং বলে, ‘এই ধরনের হামলা মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক সমাধানের পথ আরও কঠিন করে তোলে।’
জর্ডান জানিয়ে দিয়েছে, তারা কখনোই তাদের আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেবে না এবং কোনো যুদ্ধ বা সংঘাতে দেশটিকে জড়াতে দেবে না।
ইরাক বলেছে, ‘এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সরাসরি লঙ্ঘন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।’
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বলেছে, ‘ইসরাইল কেবল আগ্রাসনের ভাষা বোঝে। এই হামলার মাধ্যমে তারা গোটা অঞ্চলকে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করার চেষ্টা করছে।’
হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘এই আগ্রাসন শুধু ইরান নয়, গোটা অঞ্চলজুড়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। ইসরাইল তাদের আগ্রাসী মনোভাব থেকে বিরত না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।’
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলে, ‘ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনার অধিকার রয়েছে এবং আত্মরক্ষার জন্য তারা প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারে।’
ইসরাইল-ইরান সংঘাতের এই সর্বশেষ পর্ব গোটা বিশ্বকে এক চরম উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। দুই দেশের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও সামরিক পদক্ষেপের মধ্যে এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্য আবারও এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে। বিশ্বনেতাদের মধ্যে যারা শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের আহ্বান এখন সময়মতো ফলপ্রসূ পদক্ষেপে রূপ নিতে না পারলে, নতুন করে আরেকটি মানবিক সংকট তৈরির আশঙ্কা বাড়বে। বিশ্ববাসী তাই এই মুহূর্তে দ্রুত একটি দায়িত্বশীল ও কূটনৈতিক সমাধানের প্রত্যাশা করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ