
ছবি: সংগৃহীত
চার দিনের গুরুত্বপূর্ণ সফর শেষে শনিবার (১৪ জুন) দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর এই সফরকে কেন্দ্র করে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ছিল, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলেও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার এই সফরের তাৎপর্য ও সাফল্য ব্যাখ্যা করে শুক্রবার রাতে এক স্ট্যাটাস দেন তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ফেসবুকে দেওয়া এই স্ট্যাটাসে সফরের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য অর্জনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
এসব অর্জন শুধু কূটনৈতিক অগ্রগতি নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সম্পদ পুনরুদ্ধার অভিযান এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
১. ব্রিটিশ রাজা চার্লসের কাছ থেকে পুরস্কার ও একান্ত বৈঠক
প্রেস সচিবের দেওয়া তথ্যমতে, এই সফরে অধ্যাপক ইউনূস ব্রিটেনের রাজা চার্লসের কাছ থেকে একটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মাননা গ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রধান রাজা চার্লসের সঙ্গে তিনি প্রায় ৩০ মিনিটের একান্ত বৈঠক করেন।
এই বৈঠক এবং সম্মাননা প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, “এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত সম্মান নয়, বরং বাংলাদেশের চলমান ‘জুলাই আন্দোলন’ এবং দেশে ঘটতে থাকা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতি ব্রিটিশ রাজপরিবারের একটি প্রতীকী স্বীকৃতি।”
তিনি আরও বলেন, এই সম্মাননা মূলত বিশ্বে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রোল মডেল হয়ে ওঠার একটি বার্তা বহন করে।
২. বিএনপির প্রধান নেতার সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠক
সফরের দ্বিতীয় দিনেই লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকা এই শীর্ষ নেতার সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের এমন বৈঠক বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “এই বৈঠক ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের সম্ভাব্য পথ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য শুরু হয়েছে 'গেম ওভার' পর্যায়।”
তিনি আরও বলেন, “এই বৈঠকের পর রাজনীতি একটি নতুন গতিপথে প্রবেশ করছে, যেখানে ঐক্য, অন্তর্ভুক্তি এবং গণতান্ত্রিক স্বীকৃতিই মুখ্য হবে।”
৩. এনসিএ কর্তৃক দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকের £১৭০ মিলিয়ন সম্পদ জব্দ
প্রেস সচিবের স্ট্যাটাসে তৃতীয় বড় অর্জন হিসেবে উল্লেখ করা হয় যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA)-র এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কথা। এজেন্সিটি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক শীর্ষ সহযোগীর ১৭০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে।
শফিকুল আলম বলেন, “এটি এনসিএ-র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিমাণ সম্পদ জব্দের ঘটনা। এই ঘটনা দুর্নীতিবাজদের জন্য এক শক্ত বার্তা—কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “এটি শুধু একটি সম্পদ জব্দের ঘটনা নয়, বরং এই সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান যে দৃঢ় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তার একটি পরিষ্কার প্রমাণ।”
৪. বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পদ পুনরুদ্ধার নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক
সফরের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও ব্রিটিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এই বৈঠকগুলোতে আলোচনার মূল বিষয় ছিল—বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হওয়া সম্পদ কীভাবে আইনি উপায়ে ফিরিয়ে আনা যায়।
প্রেস সচিব বলেন, “এই আলোচনা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করেছে। আশা করা যায়, এই অভিজ্ঞতা কেবল যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নয়, অন্য দেশগুলোতেও বাংলাদেশের সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় সহায়ক হবে।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি অর্থনৈতিক অপরাধ দমনে আন্তঃদেশীয় সমঝোতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
৫. রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন সম্ভাবনা
সফরের শেষ অর্জন হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন আশার সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, “ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক যোগাযোগের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।”
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গেও অধ্যাপক ইউনূসের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আঞ্চলিক সংলাপ শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এমন এক সময়ে এই আলোচনা হলো, যখন কক্সবাজার ও ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস পাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর ছিল বহুমাত্রিক—রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, প্রশাসনিক এবং মানবিক অঙ্গনে। রাজা চার্লসের সঙ্গে বৈঠক থেকে শুরু করে বিএনপি নেতার সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং রোহিঙ্গা সংকটে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সফর ইতিবাচক অগ্রগতির বার্তা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অর্জনগুলো কেবল তাৎক্ষণিক নয়, বরং আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ