
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে জমে থাকা উত্তেজনা শুক্রবার (১৩ জুন) রাতভর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে যখন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হচ্ছে, তখনই হঠাৎ করে আকাশ থেকে নেমে আসে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলা। লক্ষ্য ছিল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি এবং পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রগুলো। শুধু ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ নয়, একই সঙ্গে ছিল গোয়েন্দা ড্রোন এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থাও।
ইসরায়েলি এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানও দাঁড়িয়ে থাকেনি। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে রাতভর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে দেশটি। তেল আবিবসহ মধ্য ইসরায়েলের বহু অঞ্চলে আঘাত হেনেছে ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বহু ভবন, ধোঁয়ায় ঢেকে যায় শহরের আকাশ। আর এভাবেই বিশ্ববাসীর সামনে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এই দ্বন্দ্ব আর শুধু মধ্যপ্রাচ্যের সীমাবদ্ধতায় নেই, বরং এটি বৈশ্বিক এক সংঘর্ষে রূপ নিতে চলেছে।
শুক্রবার রাত ৯টার কিছু পর ইসরায়েল ‘প্রথম আঘাত’ হানে। মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণা কেন্দ্রগুলো এবং আইআরজিসির (ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস) গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি।
প্রথম পর্যায়ের হামলায় আরাক, ফোর্ডু এবং নাতাঞ্জের মতো পরমাণু স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় ইরানি সংবাদমাধ্যম। এতে নিহত হন ইরানের অন্তত সাতজন পরমাণু বিজ্ঞানী ও তিনজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। সরকারি সূত্রে এখনও বিস্তারিত প্রকাশ না হলেও, কূটনৈতিক মহলে এই নিহতদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে, যারা ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক সক্ষমতার স্তম্ভ বলে বিবেচিত।
ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিশোধ নিতে দেরি করেনি ইরান। রাত ১১টার পরপরই একাধিক দফায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও রকেট হামলা শুরু হয়। ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের দিকে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। যদিও ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) দাবি করে, প্রকৃত সংখ্যা ১০০-র নিচে।
তেল আবিব, হাইফা, আশকেলনসহ মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলের বহু শহরে ব্যাপক আঘাত হানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। কিছু ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই প্রতিহত হয়, কিন্তু বেশ কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
বিশেষ করে তেল আবিবের একটি বহুতল ভবনে সরাসরি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যাতে অন্তত একজন নিহত এবং ৬০ জনের বেশি আহত হন। শহরের বিভিন্ন অংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্র ও ভূগর্ভস্থ বাংকারে আশ্রয় নিতে ছোটাছুটি শুরু করে।
এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র চুপ করে থাকেনি। ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ধ্বংসকারী যুদ্ধজাহাজ USS Thomas Hudner-কে পশ্চিম ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে মোতায়েন করেছে। এই যুদ্ধজাহাজে রয়েছে উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যা এই মুহূর্তে ইসরায়েলের জন্য নিরাপত্তা দেয়াল হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া কাতারের আমির মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি উভয় পক্ষকে উত্তেজনা হ্রাসের আহ্বান জানান এবং কূটনৈতিক সমাধানকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেওয়ার ওপর জোর দেন।
ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলি বাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে থাকা নারী পাইলটকে জীবিত আটক করা সম্ভব হয়েছে। ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ওই নারী পাইলটের ভিডিও প্রকাশ করা হয়। যদিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেনি।
রাতভর সংঘর্ষের একপর্যায়ে ইরানের রাজধানী তেহরানের মেহরাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে বিমানবন্দরে আগুন লেগে যায় এবং ঘন কালো ধোঁয়া আশপাশের এলাকা ঢেকে ফেলে। এই বিস্ফোরণ ইসরায়েলের হামলারই অংশ কি না, তা নিশ্চিত নয়; তবে ইরানের সেনাবাহিনী এটিকে "সাবোটাজ" বলে আখ্যা দিয়েছে।
রাশিয়ার প্রভাবশালী সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আপতি আলাদিনোভ বলেন, “এই সংঘর্ষ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভিক সূচনা। এই মুহূর্তে বিশ্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা আগুনে ঘি ঢালবে, না নিভানোর চেষ্টা করবে।” রুশ এই কর্মকর্তা আরও জানান, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া এই সংঘাতকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা বিশ্ব রাজনীতির দিক নির্ধারণ করবে।”
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েল সম্মুখ যুদ্ধে নামতে চায়, আমরাও প্রস্তুত। এবার শুধু পাল্টা হামলা নয়, আমরা চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেব। ইসরায়েলের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
তিনি ইরানের সামরিক বাহিনীকে সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেন, "এই হামলার পরিণাম চরম হতে চলেছে।"
১৩ জুনের রাতটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে অন্যতম রক্তাক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ এক রাত। ইসরায়েলের পরিকল্পিত এবং সরাসরি সামরিক আঘাত ও ইরানের পাল্টা প্রতিশোধ গোটা অঞ্চলকে টেনে নিয়ে গেছে যুদ্ধের কিনারায়।
বিশ্ব সম্প্রদায় এখন গভীর উদ্বেগে তাকিয়ে আছে এই সংঘাতের ভবিষ্যতের দিকে। এটি কেবল দু'টি দেশের লড়াই নয়—বরং এটি বিশ্বব্যবস্থার অস্থিরতার নতুন অধ্যায়ও হতে পারে। পরমাণু কর্মসূচি, প্রতিরক্ষা জোট, ভূরাজনীতি এবং ধর্মীয় আদর্শের এই সংঘাত হয়তো এখনো পুরোপুরি বিস্ফোরিত হয়নি, কিন্তু যে বারুদ ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি বহুলাংশে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ