
ছবি: সংগৃহীত
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচজন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন যাত্রী। শনিবার (১৪ জুন) ভোরের দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের নূরজাহানপুর এলাকায়। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়া।
ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজমুল হক বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই পাঁচজন নিহত হন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম ও পরিচয় জানা যায়নি। আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আমের মৌসুম চলায় নূরজাহানপুর এলাকায় মহাসড়কের পাশে আমবোঝাই বেশ কয়েকটি ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। রাতভর আম লোড ও পরিবহনের কারণে ওই সময়টাতে মহাসড়কটিতে ব্যাপক যানবাহন চলাচল হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী নাবিল পরিবহনের একটি নন-এসি বাস, যার চালক ঘুমাচ্ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা মারে।
ধাক্কার শব্দে আশপাশ কেঁপে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই বাসের সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ভেতরে থাকা যাত্রীরা চিৎকার করতে থাকেন। দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই পাঁচজনের মৃত্যু হয় এবং অন্তত ১৫ জন গুরুতর আহত হন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ঘোড়াঘাট থানার পুলিশ এবং দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি উদ্ধারকারী দল। তারা প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী উদ্ধার অভিযান চালিয়ে বাসের ভেতর থেকে আহতদের বের করে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, “বাসটি ট্রাকের পেছনে ঢুকে যাওয়ায় সামনের যাত্রীরা মারাত্মকভাবে আটকে পড়েন। কাঁচ ভেঙে ও কাটার মেশিন দিয়ে বাসের সামনের অংশ কেটে ভেতরে ঢুকে আহতদের উদ্ধার করতে হয়েছে।”
নিহতদের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। তারা কেউ ট্রাকের পাশে ছিলেন, কেউবা বাসের সামনের সিটে বসা ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
ঘোড়াঘাট থানার ওসি নজমুল হক বলেন, “আমরা মৃতদেহ শনাক্তে কাজ করছি। যাত্রীদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। আহতদের পরিচয় শনাক্ত হলে নিহতদের নামও জানা যাবে বলে আশা করছি।”
দুর্ঘটনার ফলে দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কে প্রায় দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে মহাসড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে দুর্ঘটনাকবলিত বাস ও ট্রাক সরিয়ে ফেলা হলে সকাল ৭টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিদিন ভোররাতে এই মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকে শত শত আমবোঝাই ট্রাক। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে। “এই রুটে অনেক সময়ই ট্রাকগুলো কোনো ধরনের হ্যাজার্ড লাইট বা সংকেত না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে ঘন কুয়াশা বা ঘুমিয়ে পড়া চালকদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে,” বলেন এক বাসিন্দা।
এ দুর্ঘটনার পর যাত্রী ও স্থানীয়রা নাবিল পরিবহনের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, চালক ও সহকারী দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং সময়মতো বাস চালাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন বা মনোযোগ হারান।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় এমন প্রাণহানি বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়, তবে প্রতিবারই অসতর্কতা, নিয়ন্ত্রণহীন গতি ও সড়কের অব্যবস্থাপনা প্রশ্ন তুলে দেয়। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাও সেই করুণ বাস্তবতার নতুন একটি সংযোজন।
প্রশাসন, পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং জনগণ—সবার সম্মিলিত সচেতনতাই পারে এমন দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ