
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শুরু হতে যাচ্ছে এমন এক ক্লাব প্রতিযোগিতা, যা অনেকের চোখে জাতীয় দলের বিশ্বকাপকেও হার মানাতে পারে। নাম ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ, তবে এবার এর আয়োজন, দলসংখ্যা, পরিসর, সময়কাল, আর অর্থনৈতিক গুরুত্ব সব মিলিয়ে এটি অনেকটা বিশ্বকাপের ছায়া। ফুটবলের নতুন যুগের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এই টুর্নামেন্টকে, যেখানে প্রথমবারের মতো ৩২টি ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ১২টি ভেন্যুতে। আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র—যারা ২০২৬ সালে জাতীয় দলের বিশ্বকাপও আয়োজন করবে—এই আসরকে তাই মনে করা হচ্ছে সেই বিশ্বকাপেরই একটি পূর্ণাঙ্গ মহড়া।
বাংলাদেশ সময় রোববার সকাল ৬টায় ফ্লোরিডার হার্ড রক স্টেডিয়ামে পর্দা উঠছে নতুন ধাঁচের ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের। উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হবে মিসরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আল আহলি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে আলোড়ন তোলা দল ইন্টার মিয়ামি, যাদের শিবিরে রয়েছেন আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা লিওনেল মেসি। এক মাসব্যাপী চলবে এই উত্তেজনার মহাযুদ্ধ, যার ফাইনাল ১৩ জুলাই।
২০২৫ ক্লাব বিশ্বকাপ: এক নজরে
দলসংখ্যা: ৩২
ম্যাচ সংখ্যা: ৬৩
গ্রুপ: ৮টি
ভেন্যু: যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি স্টেডিয়াম
পুরস্কার: মোট প্রাইজমানি ১ বিলিয়ন ডলার, চ্যাম্পিয়ন পাবে ১২৫ মিলিয়ন ডলার
উপস্থিত দেশ: ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, কনকাকাফ, ওশেনিয়া
এই টুর্নামেন্টটি আয়োজনের ধরন ও ফরম্যাটের দিক দিয়ে এতটাই বিশাল এবং বৈশ্বিক রূপ পেয়েছে যে, অনেকেই বলছেন—এটাই জাতীয় দলের বিশ্বকাপের পরে সবচেয়ে বড় ফুটবল আয়োজন। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিল মাত্র ১৩টি দেশ—ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকা থেকে। সেখানে এবার ক্লাব বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব থাকছে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে।
ইউরোপ থেকে থাকছে ১২টি দল, যার মধ্যে রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজি, বায়ার্ন মিউনিখের মতো ক্লাব পরাশক্তি। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ৬টি ক্লাবের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, যাদের অনেকেই ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে পরিচিত। এশিয়া, আফ্রিকা ও কনকাকাফ অঞ্চল থেকে আসছে ৪টি করে ক্লাব। ওশেনিয়া ও স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে থাকছে একটি করে ক্লাব।
এই ক্লাবগুলোতে খেলছেন বিশ্বের প্রায় ৮০টির বেশি দেশের ফুটবলার। ফলে এটি শুধু ক্লাব পর্যায়ের লড়াই নয়, এক অর্থে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফুটবল প্রতিভাগুলোরও সম্মিলিত প্রদর্শনী।
এই ঐতিহাসিক আসরে কিছু বিখ্যাত ক্লাব ও তারকার অনুপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। নিয়ম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে না পারায় বার্সেলোনা, লিভারপুল ও নাপোলির মতো বড় ক্লাবগুলো নেই এই আসরে। একইভাবে মাঠে দেখা যাবে না ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মোহাম্মদ সালাহ, কেভিন ডি ব্রুইনা, লামিনে ইয়ামাল, নেইমারদের মতো তারকা ফুটবলারদেরও। তবে এতে ক্লাব বিশ্বকাপের প্রতি আগ্রহ কিংবা উত্তেজনা এতটুকু কমেনি। কারণ, যে তারকাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের নিয়েই দর্শকরা দারুণ রোমাঞ্চিত।
লিওনেল মেসিকে ঘিরে যেমন আগ্রহ তুঙ্গে, তেমনি দেখা যাবে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, কাইলিয়ান এমবাপে, আর্লিং হালান্ড, জামাল মুসিয়ালা, জ্যুড বেলিংহ্যাম, হুয়ান আলভারেজদের মতো তরুণ ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের, যারা এই টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রমাণের মঞ্চ পেয়েছেন।
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো এ টুর্নামেন্টকে ইতোমধ্যেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার ভাষায়, “ফুটবলে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে এবারের ক্লাব বিশ্বকাপ। অনেকটা ১৯৩০ সালের জাতীয় দলের প্রথম বিশ্বকাপের মতো। মানুষ আজও সেই বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা করে। ঠিক তেমনি ২০২৫ সালের এই ক্লাব বিশ্বকাপও চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটা গোটা বিশ্বের বিশ্বকাপ।”
এই উক্তির সঙ্গে অনেক ফুটবল বিশ্লেষক একমত। কারণ, এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে যেমন অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হয়েছে, তেমনি বিপুল আয়োজন, সম্প্রচারের কভারেজ এবং বৈশ্বিক আকর্ষণ একে পরিণত করেছে ‘দ্বিতীয় বিশ্বকাপ’-এ।
বিশ্ব ফুটবলের রাজনীতিতেও এই টুর্নামেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৬ সালে জাতীয় দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করবে মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে যৌথভাবে। তাই ২০২৫ সালের ক্লাব বিশ্বকাপকে অনেকে দেখছেন সেই বিশাল আয়োজনের ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে।
এই ক্লাব বিশ্বকাপ শুধু খেলোয়াড় নয়, কোচ, বিশ্লেষক, দর্শক, সম্প্রচারক এবং ক্রীড়া অর্থনীতিবিদদেরও ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে। একে অনেকে বলছেন, বিশ্ব ফুটবলের বাণিজ্যিক ও প্রতিযোগিতামূলক বিকাশের নতুন ধাপ।
সত্যিকার অর্থেই এবারের ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। জাতীয় দলের বাইরেও যে ক্লাব ফুটবল আন্তর্জাতিকভাবে কতটা জনপ্রিয় ও শক্তিশালী, তা এবার সবার চোখে আরও স্পষ্ট হবে। নতুন এই টুর্নামেন্ট হয়তো ভবিষ্যতের জন্য এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যার আলোয় ফুটবলের পরবর্তী পথচলা আরও গতিশীল ও গ্লোবাল হবে।
রোববার ভোরে আল আহলি বনাম ইন্টার মিয়ামির ম্যাচ দিয়ে যে বাঁশি বাজবে, তা শুধু একটি ম্যাচ শুরু করার সংকেত নয়—এটি হবে বিশ্ব ফুটবলের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ