
ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বিমান হামলায় ইরানের বেশ কয়েকটি সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অক্ষত রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)। একইসঙ্গে সংস্থাটি এ ধরনের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও নিরাপত্তার জন্য ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানে অবস্থিত আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধিত ও নজরদারিতে থাকা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা— ফোরদো, ইস্পাহান এবং বুশেহর—এই তিনটিতে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি।
আইএইএ প্রধান রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি জানিয়েছেন, সংস্থাটি ইরানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। তিনি জানান, তারা নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনার কাজ করছেন এবং সম্ভাব্য তেজস্ক্রিয়তা কিংবা ক্ষতির মাত্রা যাচাই করার জন্য স্যাটেলাইট ইমেজ ও স্থানীয় পর্যবেক্ষণ কাজে লাগানো হচ্ছে।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই স্থাপনাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ফোরদো-র পারমাণবিক জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি কোম শহরের প্রায় ২০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ স্থাপনার আওতায় পড়ে। গ্রোসি জানান, এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো বিস্ফোরণ, বিকিরণ বৃদ্ধি বা অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একইভাবে ইস্পাহান শহরের পারমাণবিক স্থাপনায়ও কোনো ধরণের বোমাবর্ষণ হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
আরও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্র আছে, তা হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী বুশেহর। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। আইএইএ-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বুশেহরের প্ল্যান্টও নিরাপদ রয়েছে এবং এর তেজস্ক্রিয় পদার্থের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে।
তবে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো ইসরায়েল নাতানজ শহরের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা বর্ষণ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মাত্রায় কোনো বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়নি এবং আইএইএ সেখানে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না, তারপরও সংস্থাটি বলেছে—এই ধরনের হামলা ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
আইএইএ মহাপরিচালক গ্রোসি এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা আগেও বলেছি, যেকোনো পরিস্থিতিতে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে কখনোই সামরিক হামলার লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। এটি শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের জন্য নয়, বরং গোটা অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য বড় ধরনের পরিবেশগত এবং মানবিক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই হামলা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি—আরও উত্তেজনা পরিহার করুন, সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করুন এবং পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তাকে কোনোভাবেই হুমকির মুখে ফেলবেন না।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে এই ঘোষণা কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক দুশ্চিন্তা প্রশমিত করতে পারে। তবে এটি খুবই স্পষ্ট যে, পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর সামরিক হামলা চালানো হলে কেবল ইরানই নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
এদিকে, তেহরানের পক্ষ থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পূর্ণ সুরক্ষিত এবং প্রতিটি কেন্দ্রে এখনো নিরবচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি চলছে। ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থা জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিচালনা করছে এবং প্রয়োজনে প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে।
উল্লেখ্য, ফোরদো ও নাতানজ—দুটিই ভূগর্ভস্থ স্থাপনা হওয়ায় এগুলোতে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা দ্বারা ক্ষতি সাধন করা কঠিন। তবে, repeated হামলা বা লক্ষ্যভ্রষ্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতে এমন আঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও পরিবেশবাদীরাও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলছে, এসব স্থাপনায় একবার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে তা চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমার মতো মারাত্মক পরিণতি তৈরি করতে পারে।
বর্তমানে, আইএইএ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে একটি জোরালো বার্তা পাঠাতে চাইছে—পারমাণবিক স্থাপনাকে রক্ষা করা কেবল একটি দেশের দায়িত্ব নয়, বরং এটি গোটা মানবজাতির ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, আইএইএ প্রেস ব্রিফিং
বাংলাবার্তা/এমএইচ