
ছবি: সংগৃহীত
গুজরাটের আহমেদাবাদে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাটি শুধুমাত্র ভারত নয়, গোটা বিশ্বের এয়ার ট্রাভেল সেক্টরে এক মর্মান্তিক শোকের অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের এই দুর্ঘটনায় প্রায় তিন শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে নজিরবিহীন ও হৃদয়বিদারক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার যেটি আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে উড্ডয়ন করার পরপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্শ্ববর্তী মেঘানিনগর এলাকার একটি আবাসিক ভবন ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ওপর আছড়ে পড়ে বিধ্বংসী তাণ্ডব চালায়।
বিমানটির আকস্মিক বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে কী ছিল মূল কারণ?—এটাই এখন প্রশ্ন। দীর্ঘ এক দশকের মধ্যে বিশ্বে সংঘটিত সবচেয়ে বিধ্বংসী বিমান দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বিমান চলাচল ও এভিয়েশন খাতে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা মরিয়া হয়ে তদন্ত ও বিশ্লেষণে নেমেছেন। তারা মূলত ‘উড্ডয়নকালীন ডানার ফ্ল্যাপের অস্বাভাবিক অবস্থান’কে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
উড়োজাহাজের ডানার পেছনে থাকা ‘ফ্ল্যাপ’ এবং ডানার সামনের অংশের ‘স্ল্যাট’ হলো বিশেষ ধরণের বর্ধিতাংশ যা উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় পরিসর বাড়িয়ে ও গতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, উড্ডয়নের সময় ফ্ল্যাপ ও স্ল্যাট উন্মুক্ত থাকে যা বিমানকে কম গতিতে নিরাপদে আকাশে উঠতে সাহায্য করে। এরপর একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ফ্ল্যাপগুলো গুটিয়ে নেওয়া হয়।
বিবিসির যাচাই করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিমানটি উড্ডয়নকালে তার নিচের চাকা খোলা অবস্থায় এবং ফ্ল্যাপগুলো গুটানো অবস্থায় ছিল। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ জিওফ্রে টমাস বলছেন, “উড্ডয়ন হওয়ার পর এত দ্রুত ফ্ল্যাপগুলো গুটানো খুবই অস্বাভাবিক এবং এটি দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “সাধারণত উড়োজাহাজ উড্ডয়নের ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে নিচের চাকা গুটিয়ে নেয় এবং ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ফ্ল্যাপগুলো গুটিয়ে নেওয়া হয়। এই নিয়ম থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক।”
আরেক বিশেষজ্ঞ টেরি টোজারও একই রকম মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “ভিডিও ফুটেজের মানের কারণে স্পষ্ট নিশ্চিত হওয়া কঠিন, কিন্তু মনে হচ্ছে ফ্ল্যাপগুলো ঠিকভাবে অবস্থান নেয়নি।”
কাতার এয়ারওয়েজের সাবেক পাইলট ক্যাপ্টেন মো. ইউনূস এক গণমাধ্যমকে বলেন, “উড্ডয়নের সময় ফ্ল্যাপ ও স্ল্যাটের সঠিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্ল্যাপ বন্ধ থাকলে বিমান ঠিক মতো ওঠার শক্তি পায় না। আর এই ফ্লাইটে ছিল ফুল লোড, অর্থাৎ ২৪২ যাত্রী, মালামাল ও প্রায় ৬০ টন জ্বালানি। এমন অবস্থায় ফ্ল্যাপ বন্ধ থাকলে উড়োজাহাজের ওজন সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।”
তিনি আরও জানান, “ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন অভিজ্ঞ এবং একজন ইনস্ট্রাক্টর, কিন্তু কো-পাইলট ছিলেন তুলনামূলক নবিশ। তাই দুর্ঘটনার পেছনে হিউম্যান এরর (মানব ত্রুটি) এবং যান্ত্রিক ত্রুটির সংমিশ্রণ থাকতে পারে, যা তদন্ত শেষে স্পষ্ট হবে।”
সাবেক পাইলট ও নিউ ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মার্কো চ্যান বলেন, “ফ্ল্যাপ সঠিকভাবে না থাকার বিষয়টি মানব ত্রুটির সম্ভাবনাকেই জোরদার করে। তবে ভিডিওর রেজ্যুলেশন কম হওয়ায় তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
মানব ত্রুটি বা পাইলটের ভুল অভ্যাস থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আগে থেকেই এভিয়েশন সেক্টরে একটা বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে পাইলটদের প্রশিক্ষণ আরও কঠোর ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি।
দূর্ঘটনার পরপরই বোয়িং কোম্পানি এবং ভারতের এয়ার সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ (DGCA) যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে যান্ত্রিক ত্রুটির দিকও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলটি বিশ্বের অন্যতম আধুনিক উড়োজাহাজ হলেও যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অস্বীকারযোগ্য নয়।
তদন্তকারীরা বিমানটির ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (কালো বাক্স), ককপিট ভয়েস রেকর্ডার এবং অন্যান্য সিস্টেমগুলো খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করবেন।
এই দুর্ঘটনা গোটা বিশ্বজুড়ে বিমান পরিবহণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি সংশয় জন্মিয়েছে। বিশেষ করে বোয়িংয়ের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজের সাথে যুক্ত যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি আন্তর্জাতিক বাজারে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার সঠিক কারণ উদঘাটন না হওয়া পর্যন্ত বিমানের প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্যবহারকারীদের ও বিমান চালকদের সতর্ক থাকার আহ্বান থাকবে।
আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী বিমান চলাচলের নিরাপত্তার একটি বড় সংকেত। ত্রুটি যাই হোক না কেন, দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণই আগামী দিনের জন্য অপরিহার্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার পেছনে যান্ত্রিক বা মানব ত্রুটি যাই থাকুক, সেটি সামনে এনে আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করে এমন দুর্ভাগ্য পুনরায় এড়ানোর পথ খোঁজা হবে।
জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিমান দুর্ঘটনার কারণে নিরাপত্তা বিষয়ক নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ দুর্ঘটনা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কর্তৃপক্ষের তদন্তের ওপর সমস্ত নজর এখন কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, যে কোনো নতুন তথ্য প্রকাশের সাথে সঙ্গে তা বিশ্ববাসী সামনে পাবে। যত দ্রুত সম্ভব এই রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ