
ছবি: সংগৃহীত
আজ শুক্রবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত বৈঠক। রাজনীতির অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যখানে এই বৈঠককে ঘিরে দেশ ও প্রবাসে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে চরম কৌতূহল ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিশ্লেষকদের একাংশ একে তুলনা করছেন রাজনৈতিক 'টার্নিং পয়েন্ট' বা 'শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচ' হিসেবে। কেউ বলছেন, এ বৈঠক থেকেই শুরু হতে পারে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়।
স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা (বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা থেকে ৪টা) পর্যন্ত লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই বৈঠকটি মূলত ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বা একান্তে আলোচনার মাধ্যমেই হবে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, বৈঠকের একাংশে কিছু নির্দিষ্ট সহযোগী উপস্থিত থাকতে পারেন, তবে মূল আলোচনা হবে সম্পূর্ণ রুদ্ধদ্বার এবং শুধুই দুই প্রধানের মধ্যে।
আলোচনার সম্ভাব্য এজেন্ডা
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচ্য বিষয় জানানো হয়নি, তবে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ বৈঠকে যেসব বিষয় গুরুত্ব পাবে তার মধ্যে রয়েছে:
জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ
রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও চলমান বিচারকার্য
প্রশাসন ও নিরাপত্তা কাঠামোতে নিরপেক্ষতা আনার পরিকল্পনা
বিএনপি নেতৃবৃন্দের দেশে ফেরার সম্ভাবনা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামো
রাখাইনে মানবিক করিডর স্থাপন
ইশরাক হোসেনকে শপথ না করানোর বিষয়
নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ
সমঝোতার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ তৈরি
বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে মূল দ্বন্দ্বটি হলো—বিএনপি চাইছে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হোক, অন্যদিকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধকে নির্বাচনকাল হিসেবে ধরে এগোচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান মনে করেন, "ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। এপ্রিল ও ফেব্রুয়ারির ব্যবধান সামান্য—শুধু সদিচ্ছা থাকলে এই সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যাবে।"
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও বিএনপির শীর্ষ নেতার এই বৈঠক থেকে জাতি একটি সমাধানের আশায় আছে। আমরা বিশ্বাস করি, উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটবে।"
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, "এ বৈঠকের মাধ্যমে জনগণের আশা পূরণ হোক। যারা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ চায়, তারা চায় এই আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কারের সূচনা হোক।"
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, "দেশবাসী চায় এই বৈঠকে দলীয় সংকীর্ণতা নয়, বরং জনগণের স্বার্থ নিয়ে আলোচনা হোক।"
বৈঠককে ঘিরে লন্ডনে রাজনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা সকাল থেকেই ডরচেস্টার হোটেলের সামনে অবস্থান নেবেন। তাদের মুখে প্রত্যাশার আলো—এই বৈঠকের ফলাফল জাতির জন্য শুভ বার্তা নিয়ে আসবে। হোটেল এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে, রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলাকালে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সকলের। বৈঠকের মাঝে নাশতার আয়োজন থাকবে দুই নেতার জন্য।
বৈঠকের পর দুই পক্ষ থেকেই সাংবাদিকদের ব্রিফ করার কথা রয়েছে। বৈঠক সফল হলে বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি পরবর্তী নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করবে। অন্যদিকে যদি আলোচনা ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে মাঠে সক্রিয় থাকবে বিএনপি।
একটি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপে। লন্ডনে আজকের এই বৈঠক তেমনই একটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্তময় মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে। উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহে আলোচনার মাধ্যমে যদি সমঝোতার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে দেশ এগোতে পারে, তাহলে এই বৈঠক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে থাকবে। এখন অপেক্ষা—কী বলেন ড. ইউনূস ও তারেক রহমান বৈঠক শেষে। তাঁদের মুখের হাসিই বলে দেবে আলোচনার আসল ফলাফল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ