
ছবি: সংগৃহীত
একটি বিস্ময়কর এবং গভীর কূটনৈতিক অভিঘাত সৃষ্টিকারী হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। ইসরাইলের চালানো এই পরিকল্পিত বিমান হামলায় আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীর মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ইরানের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সালামির মৃত্যুর বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি।
বিবিসি, টাইমস অব ইসরাইল এবং রয়টার্সসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, শুক্রবার ভোররাতে ইসরাইল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে একটি সামরিক অভিযানে ইরানের রাজধানী তেহরান ও তার আশপাশে বিস্ফোরক হামলা চালায়। টাইমস অব ইসরাইল দাবি করেছে, এই অভিযানে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
ইসরাইলি নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে আরও জানানো হয়, এই হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ পরমাণু বিজ্ঞানী, সামরিক কমান্ডার এবং বিপ্লবী গার্ডের একাধিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলেন হোসেইন সালামি, যিনি ২০১৯ সাল থেকে আইআরজিসি’র প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা অন্যতম শীর্ষ সামরিক নেতা।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরআইবি এবং নূর নিউজ বলেছে, এই হামলায় বেসামরিক নাগরিকদেরও প্রাণহানি হয়েছে। তেহরানের একটি আবাসিক ভবনে বোমা হামলায় নারী ও শিশুসহ বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সরকারি বার্তা সংস্থা আইআরএনএ।
তেহরানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা লক্ষ্য করে চালানো এই বিমান হামলায় বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং পুরো এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
নিহত নেতাদের মধ্যে কারা কারা আছেন?
যদিও ইরান সরকার এখনও নিহত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেনি, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলার টার্গেটে ছিলেন:
হোসেইন সালামি – আইআরজিসির প্রধান
মহসেন ফখরিজাদেহের ঘনিষ্ঠ এক পরমাণু গবেষক
আইআরজিসির রেভল্যুশনারি ইউনিটের একজন অপারেশনাল কমান্ডার
সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী অভিজ্ঞ কৌশলবিদদের একজন
এই তালিকার কেউ কেউ এর আগে সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননে পরিচালিত ছায়াযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেন, “ইরান যদি ইসরাইলকে ধ্বংসের হুমকি দেয়, আমরা তা মেনে নেব না। আমাদের প্রতিরক্ষা শুধু মুখে নয়, প্রয়োজনে আঘাত দিয়েই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।”
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, “অপারেশন রাইজিং লায়ন” একটি পূর্বনির্ধারিত প্রতিরোধমূলক অভিযান, যা ইরানের সামরিক সক্ষমতা ও পারমাণবিক উন্নয়নের হুমকি রুখতেই চালানো হয়েছে।
তারা আরও দাবি করে, এই অভিযানের মাধ্যমে ইরানের পরমাণু অস্ত্র বানানোর সক্ষমতা কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে এবং পরবর্তী পরিকল্পনার ওপর প্রভাব পড়বে।
এই হামলার পরপরই বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে বলেছে, তারা এই হামলায় ইসরাইলকে কোনোভাবে সহায়তা করেনি। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “এই ঘটনার আগাম কোনো তথ্য আমাদের ছিল না, এবং এই আঘাতের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় আকারের সংঘাতের আগুন জ্বালাতে পারে। বিশেষ করে যদি ইরান সরাসরি প্রতিশোধে নামে, তাহলে তা শুধু ইসরাইল-ইরান নয়, গোটা অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ইরান এখনো এই হামলার জবাবে কী পদক্ষেপ নেবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তবে আইআরজিসির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, "এই রক্তের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। প্রতিশোধ সময়ের অপেক্ষা মাত্র।"
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান সরাসরি ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামলা চালাতে পারে, অথবা সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, এমনকি ইয়েমেনে তাদের মিত্রদের মাধ্যমে ‘প্রক্সি রিভেঞ্জ’ নেওয়ার কৌশল বেছে নিতে পারে।
এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব নজর রেখেছে তেহরান ও তেল আবিবের দিকে। একটি ভুল পদক্ষেপ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের ভয়াবহ স্রোতে টেনে নিতে পারে। ইরান-ইসরাইল সংঘাত এখন আর গোপন শত্রুতার পর্যায়ে নেই, এটি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ