
ছবি: সংগৃহীত
শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার একটি গ্রামে এক অনন্য উদ্যোগে ধর্মীয় দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত হচ্ছে কিশোর সমাজ। উপজেলার কনেশ্বর ইউনিয়নের উত্তর সুতলকাঠি দারুস সালাম জামে মসজিদে টানা ৪০ দিন তাকবিরে উলার সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করায় ৯ কিশোরকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন পেয়েছে একটি নতুন বাইসাইকেল এবং বাকি ৮ জন পেয়েছে মানসম্পন্ন গিফট বক্স ও পাঞ্জাবি।
এই ব্যতিক্রমী ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল একটাই— কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে মসজিদমুখী করা, তাদেরকে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার ও প্রযুক্তিনির্ভর একঘেয়েমি জীবন থেকে সরিয়ে ঈমানি পথে ফেরানো।
এই বিশেষ আয়োজনটি সম্পন্ন হয় বৃহস্পতিবার (১২ জুন) মাগরিব নামাজের পর মসজিদের চত্বরে এক উৎসবমুখর পরিবেশে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, অভিভাবকরা এবং এলাকার মুসল্লিরা এই আয়োজনে অংশ নেন এবং পুরস্কার বিতরণের সময় পুরো এলাকা ছিল প্রশংসায় মুখর।
অনুষ্ঠানে পুরস্কার তুলে দেন মসজিদ কমিটি ও এলাকাবাসী। পুরো কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা এবং স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাস্টার মো. আব্দুল মজিদ, যিনি জানান, এ আয়োজন শুরু হয়েছিল চলতি বছরের রমজান মাসে, যা রমজান পরবর্তী সময়েও চলমান থাকে। মোট ২৫ জন কিশোর-যুবক এতে অংশ নেয়, কিন্তু টানা ৪০ দিন নিরবিচারে জামাতে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয় ৯ জন।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে ২০০ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী মো. সিফাত হোসেন পেয়েছেন একটি নতুন বাইসাইকেল। অন্যদিকে ১৮৫ ওয়াক্ত নামাজে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী ৮ কিশোরকে পাঞ্জাবি ও গিফট বক্স প্রদান করা হয়।
মসজিদ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও সমাজসেবক মো. মনসুর খান বলেন, “আমি বিদেশে দেখেছি এমন অনেক সুন্দর আয়োজন। বিদেশ ফেরত হওয়ার পর আমি মসজিদ কমিটিকে এ নিয়ে আলোচনা করি। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।” তিনি আরও বলেন, এই উদ্যোগ আগামীতে মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক পর্যায়েও চলমান রাখতে চান তারা।
মসজিদের খতিব ও ইমাম হাফেজ মাওলানা সায়াদাত হোসাইন বলেন, “পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারীকে আল্লাহ নিজ হাতে পুরস্কৃত করবেন— এ বিশ্বাস থেকেই আমরা চাই শিশুরা যেন নামাজের প্রতি আগ্রহী হয়।” তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “এই উদ্যোগ শুধু উত্তর সুতলকাঠি নয়, গোটা ইউনিয়ন, উপজেলা, এমনকি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।”
তিনি বলেন, “মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে শিশু-কিশোরদের মনে ও আচরণে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তার বিকল্প পথ হতে পারে নামাজ ও ধর্মীয় শিক্ষা। যারা এখন নিয়মিত জামাতে অংশ নিচ্ছে, তারা ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হয়ে উঠবে— এটা আমি বিশ্বাস করি।”
পুরস্কারপ্রাপ্ত কিশোর মো. সিফাত হোসেন বলেন, “শুধু বাইসাইকেল পাওয়ার জন্য আমি নামাজ পড়িনি। আমি বুঝেছি, এটা আমার দায়িত্ব। এখন আমি নামাজের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। চাই জীবনের বাকি সময়টাও পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ আদায় করতে পারি।”
তার চোখে কৃতজ্ঞতা ও ইচ্ছার মিলিত দীপ্তি— “আমি চাই আমার বন্ধুরাও নামাজ পড়ুক, আমরা সবাই মসজিদমুখী হই।”
এই আয়োজনের প্রশংসা করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডামুড্যা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সৈয়দ জিল্লুর রহমান মধু। তিনি বলেন, “সব ধর্মেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আজকের এই আয়োজন শুধু ইসলাম ধর্ম নয়, সার্বিকভাবে সমাজের জন্য ইতিবাচক এক বার্তা দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এই ধরনের উদ্যোগে ধর্মের পাশাপাশি মানবিকতাও বিকশিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে আনতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বড় পরিসরে নেওয়া উচিত।”
পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. কাউসার খান, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবদলের সভাপতি মো. উজ্জ্বল সিকদার, হাফেজ মাওলানা আব্দুস সাত্তার, এনামুল হক মুন্সী সহ আরও অনেকেই। এ সময় এলাকাবাসীর বিপুল উপস্থিতি দেখা যায়।
অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক অভিভাবক জানালেন, তারাও তাদের সন্তানদের আগামীবার এমন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উৎসাহ দেবেন।
ডামুড্যার উত্তর সুতলকাঠি দারুস সালাম জামে মসজিদ যে ব্যতিক্রমী উদাহরণ স্থাপন করেছে, তা দেশের প্রতিটি মসজিদে অনুকরণীয় হয়ে উঠতে পারে। কিশোরদের মধ্যে ধর্মীয় দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা গড়ে তুলতে এই ধরনের উদ্যোগ শুধু তাৎক্ষণিক পুরস্কার নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার সেতুবন্ধন।
যে সমাজ তার শিশুদের মসজিদমুখী করতে পারে, সে সমাজই আগামী দিনে শান্তিপূর্ণ, মানবিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে তুলতে পারবে—এই বার্তা যেন পৌঁছে যায় সর্বত্র।
বাংলাবার্তা/এমএইচ