
ছবি: সংগৃহীত
দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হতে না হতেই আবারও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে উঠেছে কার্যত নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। গত বছরের ৮ আগস্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই দলটির পক্ষ থেকে সরকারবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড ও ষড়যন্ত্র চলছিল।
প্রথমদিকে নানা পন্থায় সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের অপচেষ্টা চললেও সেসব ব্যর্থ হওয়ার পর, এবার আরও সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত নাশকতার ছক আঁকছে দলটি। তাদের মূল উদ্দেশ্য—দেশকে অস্থিতিশীল করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি এবং সেই সুযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়।
সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৮ জুলাই সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর একটি অভিজাত কনভেনশন হলে এক গোপন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
প্রশিক্ষণের আয়োজক হিসেবে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শেখর এবং আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম, যাঁরা বর্তমানে বিদেশে পলাতক। তাদের পক্ষে প্রশিক্ষণটি পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগ-সম্পর্কিত আরও দুই নেতা—সোহেল রানা ও শামীমা নাসরিন শম্পা। প্রশিক্ষণে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ৪০০ জন নেতাকর্মী।
তবে এই আয়োজনের জন্য কনভেনশন হলটি বুকিং নেওয়ার সময় পরিচয় দেওয়া হয় ‘জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান’-এর পক্ষ থেকে। বলা হয়, বিদেশে কর্মী পাঠানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পুরো পরিকল্পনাটি সাজানো হয়।
অংশগ্রহণকারী নেতাকর্মীরা আসেন একেকজন একেক ছদ্মনামে। কেউ পরিচয় দেন রাজমিস্ত্রি, কেউ বলেন তিনি কাঠমিস্ত্রি বা বাগান পরিচর্যাকারী। প্রশিক্ষণের সময় প্রত্যেককে শিখানো হয়—
কীভাবে হঠাৎ করে জনসমাগম ঘটাতে হবে
কোথায় কোথায় বসে নাশকতা চালানো হবে
কে কী দায়িত্ব নেবে
পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে আত্মগোপনে যাবে
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার পর কেমন ‘গণজাগরণ’ দেখানো হবে
প্রশিক্ষণের বিশেষ একটি অংশে আলোচনায় ছিল রাজধানীর শাহবাগ মোড় দখলের পরিকল্পনা। পরিকল্পনামাফিক ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া গেলে তা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে বলে তারা ধারণা করছিল।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট—এই ১১ দিনের যেকোনো একটি দিন হামলার জন্য বেছে নিতে পারে তারা। তাই রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও উপজেলাগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি এবং সে অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। মূল পরিকল্পনাকারীদের কয়েকজন ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। আমরা নিশ্চিত, তারা সফল হতে পারবে না।”
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, “যারা ফ্যাসিস্ট পন্থায় দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের আমরা ছাড় দেব না। ঢাকার আশপাশে বা যেকোনো জেলায় থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পনার মূল দায়িত্বে থাকা শামীমা নাসরিন শম্পা (গোপালগঞ্জ) ও সোহেল রানা (বরগুনা)–এই দুজনকে প্রথমে নজরদারিতে রাখা হয়। পরে এনএসআই ও এসবি-এর তথ্য অনুযায়ী তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে রাজধানীর ভাটারা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়।
গ্রেফতারের পর তাদের দুই দফা রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে আরও বিস্ফোরক তথ্য। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশের আরও কয়েকটি জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের একাধিক সদস্যকে।
সূত্র জানায়, এই পুরো পরিকল্পনার পেছনে সরাসরি নির্দেশনাদাতা ছিলেন বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাইফুজ্জামান শেখর। বিদেশে অবস্থান করেও তাঁরা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন ইউনিটকে পরিচালিত করে চলেছেন। মূল লক্ষ্য—সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা এবং শেখ হাসিনাকে ‘জনগণের দাবিতে’ দেশে ফিরিয়ে এনে নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
তারা মাঠপর্যায়ে দলীয় জনসমর্থন বাড়াতে নির্দিষ্ট ‘কোড ও সিগন্যাল’ ব্যবহার করে যোগাযোগের পদ্ধতি শিখিয়েছে। কারা কোথায় বসবে, কারা কাকে ‘রক্ষা করবে’, এবং কোথায় কোথায় হামলা হবে, এমনকি হামলার পর গায়েবি হওয়া পর্যন্ত সব পরিকল্পনাই ছক কষা ছিল।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, আওয়ামী লীগের এই নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠা তাদের ‘নিষ্ক্রিয়তার আবরণের’ নিচে ছিল সুগভীর পরিকল্পনার ফল। বর্তমানে শুধু ঢাকাই নয়, দেশের আরও অন্তত ১২টি জেলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে তারা। এসব এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ে চলছে তৎপরতা শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে ‘দলীয় পুনর্গঠন ও সরকার পুনর্দখল’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই ধারা তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। তারা এখনো ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পথেই এগোচ্ছে এবং সেজন্যই গণতন্ত্রের পথে থাকা বর্তমান সরকারের প্রতিটি উদ্যোগকে ব্যর্থ করতে মরিয়া।
সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, প্রশিক্ষণের আড়ালে নাশকতা, বিদেশে পলাতক নেতাদের মাধ্যমে নেতৃত্ব এবং দেশে থাকা কর্মীদের সক্রিয় সংঘবদ্ধতা—সব মিলিয়ে আগামী কয়েক সপ্তাহ দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এবং প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ