
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উপকূলীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে টানা ভারি বর্ষণ এবং সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করেছে। আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এর ফলে ওইসব এলাকার নিচু অঞ্চলগুলোতে সাময়িক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশে একটি সুস্পষ্ট নিম্নচাপ অবস্থান করছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় মৌসুমি বায়ু প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যার প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের অঞ্চলে টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
এই টানা বর্ষণের কারণে নদ-নদীগুলোতে পানি দ্রুত বাড়ছে। নদীর উৎসমুখ ও নিচু এলাকায় পানি প্রবেশ করে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যা আগামী কয়েকদিনে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার উদয় রায়হান বলেন, “দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে নদীগুলোর পানি ক্রমাগত বাড়ছে। এতে করে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার অনেক এলাকায় পানি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তীব্র বর্ষণ এবং নিম্নচাপজনিত জলোচ্ছ্বাস একত্রিত হয়ে এক ধরনের হাইব্রিড বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের বন্যা সাধারণত বেশি সময় ধরে স্থায়ী না হলেও এর তাৎক্ষণিক প্রভাব খুব ভয়াবহ হয়। ঘরবাড়ি, ফসল, মাছের ঘের এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা হঠাৎ প্লাবিত হয়ে জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে।”
চলতি জুলাই মাসের ১০ তারিখে ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। শহরের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যত অচল হয়ে যায়।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, পূর্বের সেই অভিজ্ঞতা আবারও ফিরে আসতে পারে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে অগ্রিম প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (২৬ জুলাই) রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তর এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর জন্য ১ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিবেগে দক্ষিণ-পূর্ব বা পূর্ব দিক থেকে অস্থায়ীভাবে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টিরও সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “এসব এলাকায় নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। নৌযান ও ছোট ট্রলারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হচ্ছে।”
রোববার (২৭ জুলাই) সকাল পর্যন্ত আবহাওয়া অফিস থেকে দেওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক স্থানে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে।
বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। যা পরবর্তী নদী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রসহ বৃষ্টি এবং ভারি বর্ষণের যে প্রবণতা গত কয়েকদিন ধরে চলমান রয়েছে, তা এই সপ্তাহজুড়ে অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে আরও বৃষ্টিপাত হলে পানির চাপ বেড়ে বন্যা আরও বিস্তৃত হতে পারে।
বন্যা ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকগণকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগেভাগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সিভিল সোসাইটি সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া, ত্রাণ মজুত রাখা এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
বিশেষ করে কৃষক, খামারি ও মৎস্যজীবীদের উদ্দেশে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—ফসলের মাঠে অতিরিক্ত পানি জমা রোধে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করা, মাছের ঘেরের চারপাশে নিরাপত্তা বেড়া দেওয়া এবং পোলট্রি খামারগুলোকে উঁচু জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি রাখতে।
বর্তমান আবহাওয়া পরিস্থিতি ও নদীর পানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে বাংলাদেশ আবারও একটি স্বল্পস্থায়ী কিন্তু তীব্র প্রভাব ফেলা বন্যার সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষ করে উপকূলীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলার বাসিন্দাদের জন্য এটি হতে পারে এক ধরনের পূর্ব সতর্ক সংকেত।
তবে সময়মতো সতর্কতা, প্রশাসনের সক্রিয়তা ও জনগণের নিজস্ব সচেতনতা মিললে এই দুর্যোগকে অনেকটা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। সবকিছুর আগে প্রয়োজন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা সক্রিয় রাখা। কারণ প্রকৃতি কখনও সময় দেয় না—প্রস্তুত থাকতে হয় আগেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ