
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম জটিল ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সাম্প্রতিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর অবশেষে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়েছে দুই দেশ। তিন দিন ধরে চলা সংঘর্ষে প্রাণহানি, সামরিক উত্তেজনা এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সক্রিয় কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় এই শান্তি উদ্যোগে সম্মতি এসেছে। যদিও বাস্তবিক অর্থে যুদ্ধবিরতির সময় ও রূপ এখনও অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইটার পোস্টে (এক্সে) জানান, তিনি কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত ও থাইল্যান্ডের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ফুমথমের সঙ্গে পৃথকভাবে ফোনে কথা বলেছেন এবং উভয় পক্ষকেই যুদ্ধ অবসানের জন্য চাপ দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, সংঘাত যদি চলতেই থাকে, তাহলে আমেরিকা কোনোভাবেই এই দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি রাখবে না।
ট্রাম্প বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি— যুদ্ধ বন্ধ না হলে মার্কিন বাজারে প্রবেশের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আমি আশ্বস্ত হয়েছি, উভয় পক্ষই শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।”
অন্যদিকে থাইল্যান্ডের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ফুমথমও এক বিবৃতিতে ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “আমরা যুদ্ধবিরতির প্রতি নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছি। কিন্তু বাস্তবে এটি কবে থেকে কার্যকর হবে, কীভাবে বাস্তবায়ন হবে— এসব নিয়ে এখনও আলোচনা প্রয়োজন।”
গত কয়েক দিন ধরে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে গোলাবর্ষণ ও পাল্টা হামলায় কমপক্ষে ৩২ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। বিশেষ করে ‘প্রেয়াহ ভিহার’ মন্দিরসংলগ্ন এলাকা ঘিরে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ আবারও রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে।
এই সংঘর্ষের মাঝে জাতিসংঘে নিযুক্ত কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ব্যাংককের কাছে শান্তির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। নমপেন সরকারের পক্ষে বলা হয়, “সংঘর্ষের কোনো যৌক্তিকতা নেই। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।” তবে প্রথম দফায় থাইল্যান্ড এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় এবং জানায়, “শুধু কম্বোডিয়া যদি আন্তরিকতার প্রমাণ দেয়, তাহলেই আলোচনা সম্ভব।”
থাইল্যান্ড তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করলেও কম্বোডিয়া শুরু থেকেই আঞ্চলিক জোট আসিয়ান ও এর চেয়ার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, “আসিয়ানই এ অঞ্চলের সংঘাত নিরসনের জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম।”
আসিয়ান চেয়ার ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, “আমি ইতিমধ্যেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাসানকে নির্দেশ দিয়েছি, যেন দুই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। আমি নিজেও শান্তি নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগতভাবে তৎপর থাকব।”
তবে থাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা চায় না যে কোনো তৃতীয় পক্ষ এই আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকুক। থাইল্যান্ড মনে করে, “দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই বিষয়টি সমাধানযোগ্য।”
বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সামরিক সক্ষমতায় রয়েছে বড় ব্যবধান। সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের আছে আধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-১৬ ও গ্রিপেন, আর সেনা সদস্যের সংখ্যাও কম্বোডিয়ার তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। এই ব্যবধান কম্বোডিয়াকে প্রতিরক্ষায় দুর্বল করে রাখছে।
কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর এখনও সোভিয়েত আমলের পুরানো ট্যাংক ও অস্ত্রভাণ্ডারের প্রভাব রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা চীনা প্রযুক্তি ও অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, “এই সামরিক ভারসাম্যহীনতা যুদ্ধের সময় কৌশলগত দিক থেকে থাইল্যান্ডকে শক্তিশালী করে তোলে।”
এছাড়া রাজনৈতিকভাবে থাইল্যান্ড ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রঘনিষ্ঠ থাকলেও, কম্বোডিয়া এখন চীনের কৌশলগত মিত্র। এই পরস্পরবিরোধী আন্তর্জাতিক সমীকরণও সংঘাতের মোড় আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে যেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান যুদ্ধবিরতির সম্মতিটি একটি কূটনৈতিক অগ্রগতি হলেও সেটি কার্যকর হবে কি না— তা নির্ভর করবে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতায়। এখনো কোনো লিখিত চুক্তি হয়নি, হয়নি পর্যবেক্ষণ মিশন গঠনের কথাও। ফলে সীমান্তে স্থায়ী শান্তি কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়, বিশেষ করে আসিয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ চাইছে, দুই দেশ দ্রুত একটি লিখিত শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাক। তবে ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো— দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে যে ঐতিহাসিক জট রয়ে গেছে, সেটির সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা শুরু করা।
সব মিলিয়ে বলা যায়, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার এই সম্মতি একটি শুভ সূচনা হলেও তা যতক্ষণ না বাস্তবায়নের স্তরে পৌঁছায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা কেবল রাজনৈতিক আশ্বাস হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। বাস্তব সমাধানের জন্য দরকার হবে আন্তরিকতা, গঠনমূলক আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ