
ছবি: সংগৃহীত
মালয়েশিয়ায় বৈধ কর্মী ভিসা বন্ধ থাকায় ভ্রমণ ভিসার নামে অবৈধ মানবপাচার চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যা হাজার হাজার বাংলাদেশির জীবনকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে। কক্সবাজারের চকরিয়ার বমুবিল ছড়ি ইউনিয়নের মোজাফফর আহমদের মতো অনেকে কোটি টাকার বেশি খরচ করে আশার আলো নিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা শুরু করলেও, নির্যাতন আর প্রতারণার শিকার হয়ে ফিরে আসছেন স্বপ্নভঙ্গ হয়ে। এই চক্রের নেপথ্যে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অনিয়ম এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকার জটিলতা রয়েছে, যা অবৈধ পথে প্রবাস যাত্রার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
ভ্রমণ ভিসার ফাঁদে ফাঁসছে হাজারো স্বপ্ন
মোজাফফর আহমদ জানান, তিনি একটি দালালের কাছ থেকে চার লাখ ৮০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় চাকরির প্রলোভনে চুক্তিবদ্ধ হন। দালাল আশ্বাস দেন ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে পরবর্তীতে কর্মী ভিসায় রূপান্তর সম্ভব হবে। কিন্তু মালয়েশিয়ায় পৌঁছে চাকরি না পেয়ে নির্যাতনের শিকার হন, আর বাড়তি এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাধ্য হয়েই দেশে ফিরে আসেন। মোজাফফরের মতো আরেক হাজারও বাংলাদেশি একই অবস্থা সম্মুখীন হয়েছেন।
এ ধরনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবেদন এসেছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় বৈধ পথে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসংখ্য কর্মী অবৈধ পথে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত সাত মাসে অন্তত ৪২৬ জন বাংলাদেশি ভ্রমণ ভিসায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৫৬ জন বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়, আর ৭০ জন গ্রেপ্তার হয়ে সাজা ভোগ করে দেশে ফিরেছেন।
শ্রমবাজার বন্ধের পেছনের জটিলতা ও সিন্ডিকেট
গত বছরের ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর থেকে তা পুনরায় চালু করতে বাংলাদেশ সরকার ও মালয়েশিয়ার মধ্যে নানা চুক্তি ও শর্তাবলিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানালেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে নিয়োজিত কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। মালয়েশিয়া সরকারের দাবি, নির্দিষ্ট সংখ্যক অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমবাজার চালু করতে হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এটি ‘সিন্ডিকেট’ বলে উল্লেখ করে চুক্তি পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়েছে।
ড. তাসনিম সিদ্দিকী, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন, বলেন, “বাজার বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকেরা অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতি বন্ধের জন্য বৈধভাবে শ্রমবাজার চালু করা খুব জরুরি। সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাধা রয়েছে। আমাদের উচিত সবাই মিলে ঐকমত্যে আসা এবং বাজার খোলার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।”
মানবপাচার রোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরগুলোতে ভ্রমণ ভিসার নামে প্রবেশের চেষ্টা বন্ধে কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে। ফলে অনেকেই বিমানবন্দরেই আটকা পড়ে ফিরে আসছেন। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে ২৬ জানুয়ারি ১২ জন, ২১ ফেব্রুয়ারি ৪৫ জন এবং ১৪ জুলাই ৯৬ জন বাংলাদেশি ফেরত পাঠানো হয়। সর্বশেষ ২৫ জুলাই ২০৩ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারেননি। অধিকাংশের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আর্থিক তহবিলের অভাব, আবাসনের বুকিং না থাকা এবং অস্পষ্ট ভ্রমণ উদ্দেশ্য থাকার অভিযোগ ছিল।
সাজা ভোগের পর দেশে ফিরেছেন ৭০ জন
ভ্রমণ ভিসায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করেও বিভিন্ন অপরাধের জন্য ৭০ জন বাংলাদেশি সাজা ভোগ করে দেশে ফেরত এসেছেন। তারা মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইনের বিভিন্ন ধারায় সাজা পেয়েছেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সাজা শেষে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে তারা মালয়েশিয়ায় পুনঃপ্রবেশ করতে পারবেন না।
আগামীর পথ ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা এবং সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় চালু না হওয়া পর্যন্ত এই মানবপাচারের ঘটনা চলতেই থাকবে। ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, কিন্তু বিদেশি পক্ষের কিছু বাধা রয়েছে। তাই রাজনৈতিক ঐক্যমত্য এবং সংলাপের মাধ্যমে দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।”
অন্যদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, শ্রমবাজার চালু করতে হলে সিন্ডিকেটের শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তবে তারা অবৈধ প্রবেশ বন্ধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
আগামী আলোচনার আশা
আগামী ১১ আগস্ট মালয়েশিয়া সফর করছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি মালয়েশিয়ার সঙ্গে শ্রমবাজার ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এই বৈঠকের পর শ্রমবাজার আবারও চালু হবে এবং অসংখ্য শ্রমিকের স্বপ্ন পূরণ হবে।
সমাধানের চাবিকাঠি
বৈধ শ্রমবাজার পুনরায় চালু করা: সরকারি ও মালয়েশিয়ার মধ্যে চুক্তি দ্রুত পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর করা।
সিন্ডিকেটের অবসান: সিন্ডিকেটের শর্ত পরিবর্তন বা মুক্ত বাজার ব্যবস্থা তৈরি।
শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি: ভিসা ও রিক্রুটমেন্ট সংক্রান্ত সতর্কতা এবং তথ্য সরবরাহ।
শ্রেণীবদ্ধ নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা: অবৈধ মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ।
রাজনৈতিক ঐক্যমত্য ও সংলাপ: সকল রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ একযোগে উদ্যোগী হয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় ভ্রমণ ভিসার নামে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা ও মানবপাচার বন্ধ করতে হলে দ্রুত বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে সাধারণ কর্মীরা হতাশায় ডুবে যাবে এবং তাদের স্বপ্ন ভেঙে পড়বে। সরকারের পাশাপাশি জনগণ, বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান কঠিন। একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্থায়ী পরিকল্পনার মাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সুষ্ঠুভাবে চালু করা এবং মানবপাচার বন্ধ করাই সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ