
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে—এমন আশঙ্কায় দেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাতে চাপ বাড়ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বৈশ্বিক ঋণমান নির্ধারক সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল উভয়েই সতর্ক করে বলছে, এই অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে, বিশেষ করে রপ্তানিনির্ভর তৈরি পোশাক খাত ও শ্রমবাজারে।
এডিবির ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’–এর জুলাই সংস্করণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের প্রভাব রপ্তানি ও শিল্প খাতের গতি হ্রাস করতে পারে। যার ফলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কমে যেতে পারে। যদিও এবার তারা নির্দিষ্ট করে প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখ করেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে শুধু ঘরোয়া অর্থনীতিকে চাঙা করলেই চলবে না, জরুরি ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক ও বাণিজ্য আলোচনায় যেতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “আমাদের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে, যার সিংহভাগই পোশাক খাত। সেখানে অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ মানে একরকম ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’। আমাদের উৎপাদকরা তখন প্রতিযোগিতা হারাবে, অর্ডার কমে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব শ্রমবাজারে পড়বে। হাজার হাজার কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সমস্যা শুধু আর্থিক নয়, কূটনৈতিকও। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করে আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে হবে, শুল্ক না বাড়ানোই সবার জন্য মঙ্গলজনক।”
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ওপর যার প্রভাব পড়বে, কারণ এখানেই সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক নিয়োজিত, এবং দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে এই খাত থেকে।
তবে সংস্থাটি বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান ‘B+’ এবং স্বল্পমেয়াদি ‘B’ ধরে রেখেছে, যার দৃষ্টিভঙ্গি ‘স্থিতিশীল’। এতে বলা হয়, “গত দুই বছরে প্রবৃদ্ধির হার কমলেও সাম্প্রতিক মুদ্রানীতির কড়াকড়ি, নমনীয় বিনিময় হার, এবং টাকার অবমূল্যায়ন বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য কিছুটা স্থিতিশীল করেছে। ফলে আগামী বছর থেকে আবার প্রবৃদ্ধির গতি বাড়তে পারে।”
তবে তারা সতর্ক করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সংঘাত বাড়লে আগামীতে ঋণমান কমে যেতে পারে। বিশেষ করে যদি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ে বা বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি হয়।
এডিবি জানিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আরও ধীর হতে পারে। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে—রপ্তানি হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়া এবং আর্থিক নীতির সীমাবদ্ধতা।
এডিবির ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ মনমোহন প্রকাশ বলেন, “বিশ্ববাজারে চাহিদা কমেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলছে। বাংলাদেশকে দ্রুত রপ্তানি বাজারে বহুমুখীকরণ করতে হবে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে রফতানিমুখী শিল্পে নতুন গন্তব্যে নজর দিতে হবে।”
তবে আশার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য আলোচক সংস্থা USTR (United States Trade Representative) আগামী ২৯ জুলাই বাংলাদেশের সঙ্গে তৃতীয় দফা আলোচনায় বসবে। অনেকেই এই আলোচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “এই শুল্ক পুরোপুরি অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এখানে ভূ-রাজনৈতিক হিসাবও কাজ করছে। বাংলাদেশের উচিত হবে কৌশলগতভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করা, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়—ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের যুক্ত করে আলোচনায় যাওয়াই হবে সঠিক কৌশল।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের বিরূপ প্রভাব এড়াতে বাংলাদেশকে এখন ৩টি প্রধান ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে: জরুরি কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনা: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণ: নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে, বিশেষ করে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপ। দেশীয় শিল্পে উৎসাহ: অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখা।
যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক শুধু অর্থনৈতিক একক সিদ্ধান্ত নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। এই সংকটে সময়মতো কূটনৈতিক পদক্ষেপ না নিলে শুধু প্রবৃদ্ধিই নয়, দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এখনই সঠিক পরিকল্পনা, আলোচনায় সদিচ্ছা ও বাস্তবায়নে গতি জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ