
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও হতাশার চিত্র উঠে এসেছে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মুখে। সদ্য অনুষ্ঠিত একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সাবেক গভর্নর এবং অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মন্তব্যে উঠে এসেছে দেশের ব্যাংক খাতের ভয়াবহ দুর্বলতা ও শোচনীয় অব্যবস্থাপনার চিত্র।
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “ব্যাংক থেকে ৮০ ভাগ টাকা নিয়ে গেছে। এর মানে জনগণের আমানতের প্রায় পুরোটাই ঝুঁকিতে রয়েছে।” তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা স্বাভাবিক করতে হলে প্রয়োজন প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। “এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসবে, সেটি ভাবাই দুষ্কর,” মন্তব্য করেন তিনি।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সাহিত্যিক আলোচনা ও প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এই কথাগুলো বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে মোড়ক উন্মোচন করা হয় অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান রচিত বই ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা : যাপিত জীবনের আলেখ্য’।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা অর্থনীতিকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছি, কিন্তু ভালো প্রতিষ্ঠান প্রায় নেই বললেই চলে। গত ১৫ বছরে শুধু আইনের ব্যত্যয় হয়নি, প্রক্রিয়াগুলোকেও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যারা সেই প্রক্রিয়াগুলো ধ্বংস করেছে, তারাও তো বহাল তবিয়তে আছেন।”
তিনি আরও বলেন, “ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি শুধু অর্থনীতিকে ধ্বংস করেনি, রাষ্ট্রের আস্থার ভিত্তিকেও দুর্বল করেছে। এখন এই অবস্থা শুধরাতে গেলে সুশাসন ও রাজনৈতিক সংস্কার অপরিহার্য।”
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। এখানে যদি সংস্কার না হয়, তবে যতই সংস্কার-প্রচেষ্টা নেওয়া হোক, কোনো কাজে আসবে না।” তিনি মন্তব্য করেন, “রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের বাইরে নয়। বাজেট করতে গেলে সবাই সুবিধা চান, কেউই ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হন না। এটা একটা ভয়াবহ মানসিকতা।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছাড়া কোনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। গত কয়েক দশকে উন্নয়ন শুধু শহর কেন্দ্রিক হয়েছে। এখন দরকার গ্রামভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দর্শন।”
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, “আগে যেখানে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো, এখন সেখানে ৫ লাখ টাকা দিতে হয়। গতকালই এক বড় ব্যবসায়ী আমাকে এই তথ্য দিয়েছেন।”
ফখরুল বলেন, “দেশে কোথাও কোনো সুশাসন নেই। প্রশাসন, পুলিশ, আদালত—কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। তবে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর।” তিনি বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে আরও বড় সংকটে ফেলবে।”
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়ে সংস্কার আনতে হবে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কোনো সংস্কার কার্যকর হতে পারে না।”
সভাপতির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “পরিবর্তনের জন্য দায়িত্ববোধকে সর্বজনীন করতে হবে। কোনো একক সরকার বা গোষ্ঠী এই পরিবর্তন আনতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “দেশে এখন তিনটি জায়গায় সংস্কারের দরকার: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সক্ষম রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক চর্চা। এই তিন জায়গায় কাজ না হলে অর্থনীতি শুধু দুর্বলই হবে না, অবিশ্বাস্য সংকটে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “এক ব্যক্তি-নির্ভর ক্ষমতা কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা ও বিকেন্দ্রীকরণ আনতে হবে।”
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির, বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সমাজতত্ত্ববিদ খন্দকার সাখাওয়াত আলী, গবেষক ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান এবং প্রকাশক মো. সহিদ উল্লাহ।
তারা বলেন, “অর্থনীতি আগে না কি ক্ষমতা আগে—এই প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আমাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলেছে। যেমন ব্যাংক খাতে লাখ-কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তারা আরও বলেন, “সংস্কার কমিশন শুধু বৈঠক করছে, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এর মূল কারণ হলো—আমরা সমস্যার গোড়ায় যাচ্ছি না। ব্যক্তি নয়, প্রয়োজন মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।”
প্রকাশনা অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র একটি বই উন্মোচনের আয়োজন ছিল না, বরং এটি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সম্ভাব্য পথ খোঁজার এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। বক্তারা যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা কেবল ব্যাংক খাত নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক কাঠামোর দিকেই আঙুল তুলছে। আর তা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ—গণতান্ত্রিক সংস্কার, সুশাসন, এবং সত্যিকার অর্থে জনগণের অংশগ্রহণে পরিচালিত প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ