
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে জোরালো কণ্ঠস্বর উঠে এসেছে। দেশটির নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ২২০ জন সংসদ সদস্য (এমপি) ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং দীর্ঘদিনের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ধারণার প্রতি একটি সুস্পষ্ট অবস্থান প্রদর্শনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করা এমপিদের একটি বড় অংশ, অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি, লেবার পার্টির সদস্য। তবে এটি কেবল লেবারের উদ্যোগ নয়। চিঠিতে মোট নয়টি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমপিরা স্বাক্ষর করেছেন, যারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়, “ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু একটি প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, এটি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথে একটি বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ, যা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের জন্য বহুদিন ধরে আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত।”
চিঠির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, যুক্তরাজ্য যেন তার ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসেবে অবস্থানকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি ন্যায্য ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে আসে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি জানিয়েছেন, তাঁর সরকার কয়েক মাসের মধ্যেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তার এই ঘোষণার পরই যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে আলোচনা ও চাপ বাড়তে থাকে। সংসদ সদস্যদের চিঠিটি সেই রাজনৈতিক চাপেরই একটি প্রকাশ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ম্যাক্রোঁর অবস্থানের পর স্টারমারের ওপর চাপ বেড়েছে। ইউরোপের বড় শক্তিগুলোর অবস্থান যে ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির দিকে এগোচ্ছে, তার প্রতিফলনও এই চিঠিতে রয়েছে।
এমন এক সময়ে এই চিঠি এসেছে, যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইতোমধ্যে ইসরাইল-গাজা সংঘাত এবং মধ্যপ্রাচ্যের চলমান মানবিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে জরুরি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং জার্মানির প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ফ্রিডরিখ মের্জের সঙ্গে আলোচনার পর স্টারমার এক বিবৃতিতে বলেন, “ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি হবে একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক পরিকল্পনার অংশ, যার লক্ষ্য দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নিশ্চিত করা।”
স্টারমার আরও বলেন, “আমি আমাদের আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি, যাতে এই অঞ্চলে সত্যিকারের শান্তি আনা যায়। সংঘাতকবলিত মানুষের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
এছাড়া শুক্রবার সন্ধ্যায় দেওয়া এক পৃথক বিবৃতিতে তিনি জানান, যুক্তরাজ্য সরকার ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, “গাজায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ও জরুরি চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে আমরা শিশুদের সরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করব।”
উল্লেখযোগ্যভাবে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি যৌথভাবে একটি বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে ইসরাইলকে গাজায় সহায়তা প্রবেশে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা দ্রুত প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। এই বিবৃতিতে বলা হয়, “তিন দেশই তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং এক দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূচনা চায়, যা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি—উভয় জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করবে।”
তবে এই যৌথ বিবৃতিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। ফলে অনেক সংসদ সদস্য ও মানবাধিকার সংগঠন মনে করছেন, ব্রিটেনের সরকার এখনো দ্বিধার মধ্যে রয়েছে এবং তাই সংসদ সদস্যদের চিঠি এই দ্বিধা কাটাতে একটি রাজনৈতিক চাপে রূপ নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল আগেই ম্যাক্রোঁর ঘোষণার বিরোধিতা করেছে। মার্কিন প্রশাসন মনে করে, এখনই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে সেটি শান্তিপ্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইসরাইল বলছে, “এটি সন্ত্রাসীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার সামিল।” তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, আন্তর্জাতিক জনমত দিন দিন ফিলিস্তিনপন্থী হয়ে উঠছে, বিশেষ করে গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে।
ব্রিটিশ সংসদে এই চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি এখন আর শুধু কূটনৈতিক স্তরে সীমাবদ্ধ নেই, এটি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক দাবি হিসেবে উঠেছে। এখন দেখার বিষয়, স্টারমার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার এই দাবির প্রতি কীভাবে সাড়া দেয় এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কী পরিবর্তন আসে।
বিশ্ববাসী অপেক্ষা করছে— যুক্তরাজ্য কি সত্যিই ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে এবং এক সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে, নাকি কূটনৈতিক ভাষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তাদের প্রতিশ্রুতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ