
ছবি: সংগৃহীত
দেশের ইতিহাসে মাইলস্টোন স্কুলে ঘটে যাওয়া নির্মম দুর্ঘটনাটি এক গভীর শোক ও মর্মান্তিক বেদনার অধ্যায় হিসেবে স্মৃতিতে ধরা পড়ে থাকবে। একসময়ের হাসিখুশি প্রাণঘন বিদ্যালয় আজ পরিণত হয়েছে মৃত্যুর চুম্বকে, যেখানে শিক্ষার আলোতে ভাসমান শিশুরা চলে গেছে অনন্ত অন্ধকারে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ব্যক্তিগত এবং জাতিগত ক্ষতির গল্প, যেখানে প্রতিটি মা-বাবা, শিক্ষক, সহপাঠী এবং গোটা জাতি যেন কষ্টের মাঝে হারিয়ে গেছে। তবে এই সংকট মুহূর্তেও রয়েছে এক আলোকবর্তিকা—ধৈর্যের শিক্ষা এবং আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস।
সেদিনের ভয়াবহতা চোখে ভেসে ওঠে যখন আমরা ভাবি সেই শিশুসন্তানদের নিষ্পাপ হাসি আর তাদের প্রাণবন্ত দিনগুলি। বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানো তাদের কোলাহল, আর আজ সেখানে শুধু নিস্তব্ধতা এবং কেবল স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ। বাবা-মা হারিয়েছে তাদের ফুলের মতো সন্তান, বন্ধুরা হারিয়েছে স্নেহের সঙ্গী, শিক্ষকেরা হারিয়েছে প্রিয় ছাত্রছাত্রী। চারপাশ জুড়ে শুধুই কান্নার সুর আর নিথর বায়ু, যা যেন মায়ের বুক পুড়ে ছাই করে দিচ্ছে।
যেখানে শিশুরা শেখার জন্য আসতো, সেখানে আজ পড়ে আছে ভস্মীভূত ব্যাগ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া অর্ধবিচ্ছিন্ন পাঠ্যপুস্তক, আর প্রাণহীন লাশ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা প্রশ্ন করি, কে দিবে আমাদের এই অন্ধকারের অন্ত? কার হাতে আমাদের শিশুরা ফিরে পাব? আর এমন ব্যথা কাটিয়ে উঠার পথ কি আছে?
মুসলিম জীবনের অন্যতম ভিত্তি হলো বিপদ ও বিপত্তির মাঝে ধৈর্য ও ঈমান বজায় রাখা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বলেন, “আমি অবশ্যই তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয় দ্বারা পরীক্ষা করব। আর সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।” (সূরা বাকারা: ১৫৫)
বিপদ ও দুঃখের মধ্যেও মুসলমানের করণীয় হলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও ধৈর্য ধারণ করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আসল সবর তো প্রথম আঘাত লাগার সময়ই।” (বুখারি)
এক্ষেত্রে কান্না, বেদনা ও অন্তরের যন্ত্রণা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই বেদনার মাঝে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি ও বিশ্বাস অটুট থাকা আবশ্যক। ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া শুধুমাত্র মুখস্থ দোয়া নয়, এটি হৃদয়ে গভীরভাবে ধারণ করতে হয় যে সবকিছুই আল্লাহর দান এবং তিনি যাকে নেন তিনিই আবার দানকারক।
আল্লাহর কাছে ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে অনন্ত পুরস্কার। কুরআনে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দেওয়া হবে অগণিতভাবে।”
রাসূল (সা.) বলেছেন, “একজন মুমিনের ব্যাপার সত্যিই আশ্চর্যজনক! তার সব কিছুই কল্যাণময়। যদি সে আনন্দে থাকে, সে শুকরিয়া আদায় করে তা তার জন্য ভালো; আর যদি বিপদে পড়ে, সে ধৈর্য ধরে তাও তার জন্য ভালো।” (সহিহ মুসলিম)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, “যখন আল্লাহ কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাদের পরীক্ষা করেন। যে ধৈর্য ধরে, তার জন্য ধৈর্যের অবারিত প্রতিদান।” (মুসনাদে আহমদ)
এছাড়া শিশুর মৃত্যুতে মুমিন মায়ের কান্না ও ধৈর্যের জন্য আল্লাহ বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। তিরমিজি শরিফে বর্ণিত, আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ দেন, “তোমরা আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করো, যার নাম হবে বায়তুল হামদ।”
মাইলস্টোনের এই মর্মান্তিক ঘটনার শোক শুধু ব্যক্তিগত নয়, পুরো জাতির। আমাদের আবেগ শুধুমাত্র শোক প্রকাশেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। দরকার একসাথে দাঁড়ানো, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও শিশুদের পাশে থাকা, তাদের মানসিক ও আর্থিক সাহায্য করা।
একটি মুমিন হিসেবে আমাদের দোয়া ও ইস্তিগফার বর্জন করা যাবে না। প্রতিদিন আল্লাহর দরবারে ফিরে এসে আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে সবকিছু জানাতে হবে, সাহায্য চাইতে হবে এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে নতুন সকালকে স্বাগত জানানোর জন্য।
প্রতিটি সেজদায় কাতর হৃদয়ে আর্তি উঠানো হবে, নামাজের পর প্রতিটি নিশ্বাস দোয়ায় রূপ নেবে। এমন সময় আমাদের একত্র হয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করা ও পুনর্গঠন শুরু করাই বাস্তব কর্তব্য।
মাইলস্টোনের এই হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি থেকে শেখার যা আছে, তা হলো বিপদের সময় আল্লাহর ওপর অবিচল বিশ্বাস এবং ধৈর্য ধারণ। আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানির আশায় বুক বাঁধা। এই সংকট যেন আমাদের আল্লাহর পথে ফেরানোর আহ্বান হয় এবং নবীজির (সা.) বাণী মনে করিয়ে দেয়, “তুমি যখন তোমার ভাইয়ের পাশে থাকবে, তখনই আল্লাহ তোমার পাশে থাকবেন।”
আমাদের collective সওয়াব এবং কল্যাণ তখনই পূর্ণ হবে যখন আমরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করবো, মমত্ববোধ ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেবো এবং আল্লাহর হুকুম মেনে চলবো। আল্লাহ আমাদের এই মর্মান্তিক যন্ত্রণার মাঝে সহনশীলতা, শান্তি ও শক্তি দান করুন। আমীন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ