
ছবি: সংগৃহীত
মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই মানুষ আল্লাহর সাহায্য, অনুগ্রহ ও রহমতের দিকে চেয়ে থাকে। দোয়া বা প্রার্থনা সেই মহান রবের দরবারে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম, যার মাধ্যমে বান্দা তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে এবং করুণাময়ের অনুগ্রহ কামনা করে। তবে হাদিস শরিফে কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষের কথা বলা হয়েছে, যাদের দোয়া আল্লাহ কখনও ফিরিয়ে দেন না—অবশ্যই কবুল করেন। এই দোয়া শুধু আখিরাতেই নয়, দুনিয়ার জীবনেও ফলপ্রসূ হয়। নিচে সেই শ্রেণিগুলোর বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো—
১. রোগীর দোয়া—যার মাঝে রয়েছে ফেরেশতাদের আবেদনস্বরূপ পবিত্রতা
রোগাক্রান্ত মানুষ সাধারণত শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে, ফলে তারা তাদের অন্তরের গভীরতা থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। হাদিসে বলা হয়েছে, তাদের দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতোই পবিত্র এবং কবুলযোগ্য।
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন: “যখন তোমরা কোনো অসুস্থ ব্যক্তির কাছে যাও বা তাকে দেখতে যাও, তখন তাকে বলো যেন সে তোমার জন্য দোয়া করে। কারণ, তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো।” (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৯৮)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, একজন রোগী আল্লাহর দরবারে এমন এক বিশেষ অবস্থানে থাকেন, যেখানে তাঁর কান্না, কষ্ট ও আহাজারি আল্লাহর দয়ার দরজায় সরাসরি পৌঁছে যায়। রোগীর মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি দোয়া তাঁর অন্তরের ব্যথা ও তাওয়াক্কুলের সাক্ষী হয়ে যায়। এজন্য আমাদের উচিত রোগীকে শুধু সমবেদনা নয়, বরং তার কাছে নিজের জন্যও দোয়া চাইতে শেখা।
২. রোজাদারের দোয়া—ইফতারের সময় যার আবেদন ফেরানো হয় না
রমজান মাসের মর্যাদা ইসলামে অনন্য, আর সেই মাসে রোজা রাখা এক বিশেষ ইবাদত। হাদিসে আছে, একজন রোজাদারের ইফতারের সময় আল্লাহর প্রতি তার আকুল আকাঙ্ক্ষা এমন এক মাত্রায় পৌঁছে যায়, যেখানে আল্লাহ তাঁর দোয়া অগ্রাহ্য করেন না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “রোজাদারের দোয়া ইফতারের সময় ফেরানো হয় না।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৭৫৩)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইফতারের সময়ের দোয়া অত্যন্ত মূল্যবান। দিনের পর দিন আল্লাহর জন্য উপবাসের পর সেই মুহূর্তে রোজাদার ব্যক্তির অন্তর থাকে পরিপূর্ণভাবে নরম ও আত্মসমর্পিত। এই সময় বান্দা দুনিয়া ও আখিরাতের যেকোনো প্রয়োজন আল্লাহর দরবারে পেশ করলে তা কবুল হওয়ার আশা থাকে প্রবলভাবে।
৩. মা-বাবার দোয়া—সন্তানের প্রতি যে দোয়া আসমান ছুঁয়ে যায়
পিতা-মাতার দোয়া সন্তানের জন্য দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। হাদিসে এই দোয়ার প্রভাব এতটাই জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, মজলুমের দোয়ার মতোই এর কবুলিয়তের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
নবী করিম (সা.) বলেন: “তিনজনের দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়: মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং পিতার সন্তানের জন্য দোয়া।” (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৯০৫)
এই হাদিসে লক্ষণীয়, ‘মা’র বদলে ‘পিতা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে ইসলামি ব্যাখ্যাগুলোতে বলা হয়, পিতামাতার দুজনের দোয়াই সন্তানদের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পিতার দোয়া তার সন্তানদের জন্য বরকতের কারণ হতে পারে, আবার অভিশাপ হলে হতে পারে ধ্বংসের কারণও। তাই সন্তানের উচিত, মা-বাবার দোয়া লাভের জন্য সব সময় তাদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা।
৪. অদৃশ্য বা অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া—যা ফেরেশতারাও সমর্থন করে
মানবিকতা, সৌভ্রাতৃত্ব এবং পরস্পরের কল্যাণকামিতার অন্যতম প্রকাশ হচ্ছে অন্যের জন্য গোপনে দোয়া করা। এ ধরনের দোয়ার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে হাদিসে। যখন একজন মুসলমান তার অনুপস্থিত ভাই বা বোনের জন্য দোয়া করে, তখন ফেরেশতা তার জন্যও একই দোয়া করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যখন কোনো মুসলিম তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করে, তখন ফেরেশতা বলে, ‘আমিন, তোমার জন্যও তাই হোক।’” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৩২)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, গোপনে অন্যের জন্য কল্যাণ চাওয়া নিঃস্বার্থতা, আন্তরিকতা ও ঈমানদারির একটি চিহ্ন। এমন দোয়া শুধু অপরজনের জন্যই নয়, দোয়া প্রদানকারীর জন্যও আসমানের ফেরেশতারা বরকত কামনা করে। এটি মুসলিম সমাজে একে অপরের জন্য ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং ঐক্য সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম।
আল্লাহর দরবারে দোয়ার মাধ্যমেই বান্দা সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি পৌঁছায়। কিন্তু কিছু দোয়া রয়েছে, যেগুলো আল্লাহ নিজেই অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করেন। রোগী, রোজাদার, পিতা-মাতার দোয়া কিংবা অনুপস্থিত মুসলমান ভাইয়ের কল্যাণে করা দোয়া—সবগুলোই মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে সম্মানিত। তাই আমাদের উচিত এসব বিশেষ মুহূর্তকে উপলক্ষ করে নিজের ও অন্যের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আল্লাহর ওপর নির্ভর করা, দোয়ার কবুলিয়তের আশায় কখনো হতাশ না হওয়া। আল্লাহর দরবারে দোয়া কখনো বিফলে যায় না; তিনি জানেন কখন, কীভাবে, কতটুকু এবং কোন দোয়াটি বান্দার জন্য কল্যাণকর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ