
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্তত ১৬৮টি সেবা ও সেবা উপকরণে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকরের পথে এগোচ্ছে। দীর্ঘ প্রায় চার দশক পর বন্দর কর্তৃপক্ষ এমন বড় ধরনের ট্যারিফ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রস্তাব ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে এবং এখন তা আইন মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত পর্যালোচনার অপেক্ষায় রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এই নতুন ট্যারিফ গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে এবং কার্যকর হবে। তবে এই সিদ্ধান্তে দেশের আমদানি-রফতানি খাত, বিশেষ করে পোশাক শিল্পসহ রপ্তানিনির্ভর শিল্পগুলোতে বিপুল প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বন্দর পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের মোট ১৬৮ সেবা ও সেবা উপকরণের ট্যারিফ বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ, পাইলটিং, বার্থিং, টাগবোট, লিফট অন/লিফট অফ, বার্থ হায়ার, স্ট্যাফিং চার্জ, পোর্ট ডিউজসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চার্জ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই তালিকায় মাত্র চারটি সেবার ট্যারিফ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, “এই ট্যারিফ কাঠামো সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। সে সময় ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ৩১-৩২ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২১ থেকে ১২৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৪০ বছর আগের হার আজকের বাস্তবতায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এজন্যই সীমিত পরিসরে এই ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও জানান, এই বাড়তি শুল্কের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না বলেই তাঁদের ধারণা।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। আগে একটি কনটেইনার স্ট্যাফিং চার্জ ছিল ২ দশমিক ৭৩ মার্কিন ডলার, সেটি এখন বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৪১ ডলার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একইভাবে লিফট অন-লিফট অফ চার্জ আড়াই ডলার করে বাড়ছে। পাইলটিং চার্জ, বার্থ হায়ার, স্টোরেজ চার্জ এবং বার্থিং-আনবার্থিং চার্জেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়তি খরচ চাপবে।
ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনগুলো এই ট্যারিফ বৃদ্ধির বিরোধিতা করছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)–এর পরিচালক সাকিফ আহমেদ সালাম বলেন, “ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের ব্যয়বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় আগে থেকেই চাপে আছে। এখন যদি বন্দর শুল্ক এক ধাক্কায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে তা উৎপাদন খরচ ও পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দাম দুটোতেই প্রভাব ফেলবে। ফলে রফতানি কমে যেতে পারে।”
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন মনে করেন, “এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণে পণ্য আমদানি ও রফতানির খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমবে, যা এক ভয়াবহ বিপদের সূচনা হতে পারে।”
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম সাইফুল আলম বলেন, “এই মুহূর্তে ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি একটি অযাচিত ও সময়ের সাথে সঙ্গতিহীন সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক হারে ট্যারিফ নির্ধারণ করা উচিত।”
চট্টগ্রাম বন্দরের এই সিদ্ধান্তে বিদেশি শিপিং অপারেটররা জাহাজ এবং কনটেইনার ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে দেশের আমদানি পণ্যে পরিবহন ব্যয় বাড়বে, যা শেষপর্যন্ত সাধারণ ভোক্তাদের ওপরই চাপ তৈরি করবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, “আমরা কখনোই অতিরিক্ত ট্যারিফ বৃদ্ধির পক্ষে না। তবে যদি বাড়াতেই হয়, তাহলে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানো উচিত। তার বেশি হলে আমদানি-রফতানি খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।”
শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনও (বিকডা) ট্যারিফ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে একই সময়ে বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সেবায় খরচ বাড়বে, যা ব্যবসায়ীদের ওপর একধাক্কায় বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের রফতানি নির্ভর অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৩২ লাখ ৯৬ হাজার কনটেইনার এবং ১৩ কোটি মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে। বছরে বন্দরের নিজস্ব আয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এমন এক সময়, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, ডলারের অস্থিরতা, ও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতিকে নানাদিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে— তখন এই শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ ও অসন্তোষ তৈরি করেছে।
বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যবসায়ী নেতারা এই প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি অবিলম্বে স্থগিত করে অংশীজনদের সঙ্গে বসে যৌক্তিক একটি সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, শুধুমাত্র আয় বাড়ানো নয়, বরং বন্দর পরিচালনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়ানোই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশি জরুরি।
এই প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেই এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়ে কার্যকর হবে। তবে এখনও সময় রয়েছে— এই ট্যারিফ পরিবর্তন পুনর্বিবেচনা করে ব্যবসায়বান্ধব ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেয়ার। না হলে, ব্যবসায়ী মহলের ভাষায়, "এই বোঝা হয়তো অনেককেই শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করবে।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ