
ছবি: সংগৃহীত
“কার্যকর সংস্কার না হলে আবার ফিরে আসবে স্বৈরাচার। ওপরে প্রলেপ দিয়ে সমাজ বদলায় না”—এমনই তীব্র সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় আয়োজিত বিশেষ আলোচনা সভা, যার প্রতিপাদ্য ছিল “জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন”। এতে অংশ নেন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা, সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণ।
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা যদি সংস্কার বলি এবং সেটা যদি শুধু উপরে প্রলেপ হয়, তাহলে যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আজ কথা বলছি, সে আবার ফিরে আসবে—যতই আমরা সামাল দিই, যতই আইন করি। আমাদের প্রয়োজন ভিতর থেকে বদলানো, মনোজগতে পরিবর্তন।”
তিনি মনে করেন, বহু বছরের দুঃশাসনের যন্ত্রণা আজও জাতির মধ্যে গভীর ক্ষত রেখে গেছে। জাতির আত্মা আজও মুক্ত নয়। তিনি বলেন, “আমাদের মাঝে যে বীজ রয়ে গেছে—অত্যাচারের, দমন-পীড়নের—তা যদি উৎপাটন না করি, তাহলে সে আবার গজাবে। এই বীজ থেকে কীভাবে মুক্তি সম্ভব, সেটাই আজকের চ্যালেঞ্জ।”
ড. ইউনূস জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নতুন বাংলাদেশের জন্মমুহূর্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “জুলাই শুধু স্বৈরাচার মুক্তির মাস নয়, এটি আমাদের জাতিগত পুনর্জন্মের মাস। আমরা যদি এই অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি, তাহলেই আমরা সত্যিকার অর্থে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হয়ে উঠতে পারব।”
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, “প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনে ছিল সংগঠিত, পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় মদত। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এটিকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।”
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি নতুন ধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করানোর আহ্বান জানান তিনি। বলেন, “আমরা এমন এক রাষ্ট্র গঠনে কাজ করছি যেখানে কোনো নাগরিককে আর ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে না; যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা কখনও আর জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।”
নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
ড. ইউনূস জানান, বর্তমান সরকার দণ্ডবিধির সংশোধন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগদান, এবং জাতিসংঘের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে, যার আওতায় একটি সহায়ক মিশন ঢাকায় কাজ করবে। এই মিশন সরকারের পাশাপাশি সুশীল সমাজকেও কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “একটি জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ছাড়া সংস্কার ও বিচার সম্ভব নয়। একটি ম্যান্ডেটবিহীন সরকার সংস্কার করতে পারে না। তাই আগে দরকার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।”
তিনি বলেন, “বিএনপিও চায়—জুলাই মাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার হোক। যারা গুলি চালিয়েছে, হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।”
ফখরুল সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “একটি বছর খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবুও অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে, যা প্রশংসনীয়।”
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “বিচার ও সংস্কারের আগে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে সেটা জাতির জন্য এক মহাবিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে।”
তিনি শহীদ পরিবারগুলোর দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে বলেন, “এই পরিবারগুলো বিচার না দেখে নির্বাচনে আগ্রহী নয়। আমরা দাবি করি, অপরাধীদের মধ্যে অন্তত কিছু ব্যক্তির বিচার যেন চোখের সামনে দেখি।”
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান আহতদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে এবং জামায়াত সেই কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে বলে আশ্বাস দেন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হবে। তিনি দেশ ও বিদেশে থাকা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।
নাফিসের বাবা গোলাম রহমান বলেন, “আমার ছেলের খুনি আজও সরকারি চাকরিতে বহাল। আমি বিচার চাই।”
শহীদ সৈকতের বোন শ্রাবন্তী বলেন, “আমরা জুলাই সনদ প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। দ্রুত তা প্রকাশ করা হোক এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হোক।”
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক ভিডিও বার্তায় বলেন, “বাংলাদেশের এই দুর্বিষহ সময় ছিল গোটা মানবাধিকারের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। আমরা আশা করি, অপরাধীরা দ্রুত বিচারের আওতায় আসবে এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।”
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হুমা খান। শুরুতে প্রদর্শিত হয় একটি তথ্যচিত্র—যেখানে দেখানো হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের বাস্তবচিত্র এবং তাদের পরিবারের জীবনসংগ্রাম।
এই অনুষ্ঠান শুধু একটি সরকারি আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠান ছিল না, বরং এটি ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণের একটি ঐতিহাসিক মঞ্চ। এখানে উচ্চারিত প্রত্যেকটি বক্তব্য একটি বৃহৎ চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন—একটি গভীর সংস্কার, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের পথে যাত্রার আহ্বান।
বাংলাবার্তা/এমএইচ