
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আজ এক সংকটজনক মোড়ে দাঁড়িয়ে। স্থানীয়ভাবে দেশের চাহিদার প্রায় পুরোটা মেটানোর সক্ষমতা থাকলেও এবং ১৬০টির বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করলেও, এই খাতটি এখনও মারাত্মকভাবে কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ওষুধশিল্পের প্রাণ হিসেবে পরিচিত অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) উৎপাদনে দুর্বলতা, আমদানি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বিনিয়োগে অনাগ্রহ, অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নীতিগত অসঙ্গতি মিলে শিল্পটিকে সামনে এগোতে বাধা দিচ্ছে।
আমদানিনির্ভরতা ও বিপদের ইঙ্গিত
বাংলাদেশে এখনো ৮৫ শতাংশেরও বেশি ওষুধের কাঁচামাল প্রধানত চীন ও ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এমনকি ইসোমিপ্রাজল বা প্যারাসিটামলের মতো সাধারণ ওষুধ তৈরির কাঁচামালও দেশীয়ভাবে উৎপাদন সম্ভব নয়। অথচ, বিশ্বজুড়ে কোভিড-পরবর্তী সময়ে সরবরাহব্যবস্থায় পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে এই আমদানিনির্ভরতা দেশের ওষুধ নিরাপত্তাকে বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে।
বিনিয়োগ, দক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক বাধা
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, “আমরা যখন এপিআই তৈরির উদ্যোগ নিই, তখন শুধু কাঁচামাল আমদানির অনুমতি পেতেই আট-নয় মাস লেগে যায়। এতে ১৮টি পৃথক ছাড়পত্রের দরকার হয়। ততদিনে বাজার পাল্টে যায়, প্রতিযোগীরা পণ্য ছাড়ে আর আমরা বাজার হারাই।”
তিনি আরও বলেন, “চীনে এক শিল্পের উপজাত অন্য শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার ফলে উৎপাদন খরচ কমে। আমাদের দেশে এমন সমন্বিত ব্যবস্থা অনুপস্থিত।”
ওষুধ উৎপাদনকারীরা বলছেন, দক্ষ প্রসেস কেমিস্ট ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার না থাকায় অনেক সময়েই নতুন কোনো এপিআই তৈরির সম্ভাবনা অপচয় হয়। একই সঙ্গে, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হারও বড় বাধা। বাংলাদেশে সুদের হার যেখানে ১৪-১৫ শতাংশ, সেখানে ভারত বা চীনে তা মাত্র ৩-৫ শতাংশ। ফলে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এপিআই পার্ক: উচ্চাশার মাঝে বাস্তব সংকট
সরকার ঢাকার কাছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ২০০ একরের বেশি জায়গায় একটি ‘এপিআই শিল্প পার্ক’ গড়ে তুলেছে। জমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো নির্মাণ প্রায় শেষ হলেও এখনো গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা কার্যকরভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না।
রাব্বুর রেজার আশঙ্কা, “সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং সিঙ্গেল উইন্ডো ক্লিয়ারেন্স ছাড়া এই পার্কও অব্যবহৃত শিল্পাঞ্চলে পরিণত হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পেটেন্ট সংকট
বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকায় ওষুধ পেটেন্ট সংক্রান্ত কিছু ছাড় উপভোগ করে। কিন্তু ২০২6 সালের মধ্যে দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হলে এই সুবিধা উঠে যাবে। ফলে, অনেক আন্তর্জাতিকভাবে পেটেন্টকৃত এপিআই উৎপাদনে আইনগত ও আর্থিক জটিলতা বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, “পেটেন্ট ছাড় উঠে গেলে এপিআই উৎপাদনের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, পাশাপাশি আইনি জটিলতাও বাড়বে। ফলে আমাদের এখনই সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে, নইলে বহির্ভরতা আরও বেড়ে যাবে।”
বেসরকারি খাতের সীমিত উদ্যোগ
বর্তমানে স্কয়ার, বেক্সিমকো, একমি, ইনসেপটা, এসকেএফসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪০ ধরনের এপিআই উৎপাদন করছে, যার বাজারমূল্য আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু দেশীয় চাহিদা এবং সম্ভাবনার তুলনায় এটি খুবই সামান্য।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) সভাপতি আবদুল মুক্তাদির বলেন, “ওষুধ ফরমুলেশনে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু এপিআই উৎপাদনের ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় পুরো ভবনটা ঠুনকো। এটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “এলপিজি দিয়ে কোনো রাসায়নিক কারখানা চলতে পারে না, অথচ এপিআই পার্কে এখনো গ্যাস সংযোগ হয়নি। পরিবেশগত ছাড়, গবেষণা সহযোগিতা ও সরকারি স্বীকৃতি না থাকলে এই খাত এগোবে না।”
বৈশ্বিক সুযোগ এবং দেশের অপ্রস্তুতি
মহামারির পর পশ্চিমা দেশগুলো চীনের বিকল্প এপিআই সরবরাহকারী খুঁজছে। বাংলাদেশ যদি সঠিক কৌশল নিতে পারে, তাহলে এ মুহূর্তে নিজেকে একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ আছে। কিন্তু অনিশ্চিত নীতিমালা, দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, পরিবেশগত বাধা, উচ্চ সুদের হার, দক্ষ জনবলের অভাব—সব মিলিয়ে এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
পরিবেশ এবং ব্যয়জনিত বাধা
বিকন মেডিকেয়ারের সিইও মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু বলেন, “বিশেষ করে ক্যানসারের মতো ওষুধের জন্য এপিআই উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকার না পেলে এসব বিনিয়োগ টেকসই হবে না। সেই সঙ্গে, বাধ্যতামূলক এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনের জন্য অনেক খরচ লাগে, যা অনেক দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “সরকার যদি গবেষণা, উন্নয়ন এবং পরিবেশ ছাড়ের ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়, তবে কম খরচে এপিআই উৎপাদন সম্ভব।”
বাংলাদেশের ওষুধশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। একটি কার্যকর নীতিমালার মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি, কম সুদে বিনিয়োগ সহজীকরণ, এপিআই পার্কে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পরিবেশগত বাধা দূর করা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে, এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পটি আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রস্তাবিত করণীয়:
একটি কেন্দ্রীয় এপিআই নীতি দ্রুত প্রণয়ন
এপিআই পার্কে গ্যাস সংযোগসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো
সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম চালু
দক্ষ জনবল গঠনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টে সরকারি প্রণোদনা
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উৎসাহমূলক করনীতি
বাংলাদেশের ওষুধশিল্পকে যদি সত্যিকার অর্থে একটি টেকসই, নিরাপদ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এখনই সময় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং কাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এপিআই উৎপাদনের ভিত মজবুত করার। নইলে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ আমাদের প্রস্তুতিহীনতাকে কঠিন বাস্তবতায় পরিণত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ