
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে প্রেরিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ খসড়া নিয়ে সম্প্রতি রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একদিকে কিছু দল খসড়াটিকে যথার্থ ও সমন্বিত পদক্ষেপ মনে করলেও অনেকে এটিকে অসম্পূর্ণ, একতরফা ও যথাযথ ঐতিহাসিক সম্মান থেকে বঞ্চিত বলেও আখ্যা দিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের যথোপযুক্ত মর্যাদা না দেয়া এবং সনদ বাস্তবায়নে নির্ধারিত দুই বছরের সময়সীমা নিয়ে দলগুলোতে বিভক্ত মতামত লক্ষ্য করা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের সংলাপের বিরতিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনে এসব দিক উন্মোচিত হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, খসড়ার বিষয়বস্তু মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হলেও ভাষাগত ও বাক্যগত কিছু সংশোধনী দল তাদের পক্ষ থেকে জমা দেবে। তিনি বলেন, “দুই বছরের মধ্যে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে আমরা একমত।” তবে দেশের সর্বোচ্চ আইন অনুযায়ী সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস জনগণ; আইন প্রণয়নের স্থান নির্বাচিত সংসদ হওয়ায় সনদ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের খসড়াটিকে অসম্পূর্ণ ও কিছু অংশ বিপজ্জনক আখ্যা দিয়ে বলেন, দুই বছরের সময়সীমা নিয়ে কোনওরকম সমঝোতা সম্ভব নয়। তিনি প্রস্তাব করেন সনদ বাস্তবায়নে দুটি পথ গ্রহণ করা যেতে পারে: প্রথম, অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত সংসদে তা অনুমোদন; দ্বিতীয়, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন। আইনি ভিত্তি ছাড়া কার্যকর ঐকমত্য সম্ভব নয় বলে সতর্ক করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসীন বলেন, “যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি পাবে বলে স্পষ্ট দাবি জানানো হয়েছে।” তিনি কমিশনের হঠাৎ খসড়া প্রকাশের পদ্ধতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে বলেন, মৌলিক সংস্কার ব্যতীত ফ্যাসিবাদী কাঠামো দূর করা সম্ভব নয় এবং তার বাস্তবায়ন ছাড়া সনদে স্বাক্ষর নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যদি সনদে সম্মত বিষয়গুলো আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা যায়, তাহলে জনগণের মধ্যে শান্তি ফিরবে। বাধা সৃষ্টি করলে জনগণ তা মেনে নেবে না বলে সতর্ক করেন তিনি।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, খসড়ায় গণহত্যার বিচারের স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে নির্যাতিতদের উল্লেখও খসড়ায় পর্যাপ্ত নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থানের উল্লেখ করাও অপরিহার্য বলে মত দেন তিনি।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, জুলাই সনদে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। জুলাইয়ের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে গুণিতক বেশি প্রাণহানি হলেও তা সনদে অনুপস্থিত থাকায় পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়।
গণ অধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান বলেন, “জুলাই সনদে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও শহীদদের মহিমান্বিত করা হয়েছে, তবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি।” তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় জুলাই এসেছে, সেটি সনদে স্পষ্ট করা উচিত।” অতিরিক্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনের সম্ভাবনা নিয়েও সতর্ক করেছেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ প্রকাশিত খসড়া নিয়ে বলেন, এটি আইনি বাধ্যবাধকতা বিহীন ও দুর্বল উপস্থাপনা। স্বৈরাচারী শক্তির প্রতি এটি আশঙ্কাজনকভাবে নমনীয়, কারণ সনদে কোনো উল্লেখ নেই যে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের হোতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে।
রাজনৈতিক মহলে এই খসড়া নিয়ে বহুমুখী মতের কারণে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য একটি সনদ গঠনে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। অনেকের মতে, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য খসড়াটিকে পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করতে হবে। পাশাপাশি, সনদ বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো ও সময়সীমা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে আরও সংলাপ চলমান থাকলেও বর্তমান প্রতিক্রিয়াগুলো দেখায়, সনদ চূড়ান্তকরণের পথে আরো দূরদর্শী ভাবনা ও সমঝোতার প্রয়োজন। ভবিষ্যতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বৃহত্তর অংশগ্রহণ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সফলতা অর্জন কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ