
ছবি: সংগৃহীত
বিবাহ, ইসলামে শুধু সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি পূতপবিত্র ইবাদত, মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু আজকের সমাজ বাস্তবতায় আমরা প্রায়শই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হই—যদি পরিবার, বিশেষত পিতা-মাতা কোনো কারণে সন্তানের পছন্দের সঙ্গে একমত না হন, তাহলে কি সন্তান নিজের সিদ্ধান্তে, পরিবারের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবে? বিশেষ করে হারাম থেকে বাঁচার অজুহাতে যদি কেউ পালিয়ে বিয়ে করে, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটা গ্রহণযোগ্য?
এই প্রশ্নের উত্তর শুধু একটি “হ্যাঁ” বা “না” দিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ ইসলামে প্রতিটি কর্ম, বিশেষত বিয়ে, শুধু আবেগনির্ভর নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দায়িত্ব, বাস্তবতা, সামাজিক ভারসাম্য এবং অভিভাবকদের ভূমিকা।
প্রথমেই বুঝে নেওয়া জরুরি যে, ইসলামে বিয়ে শুধুমাত্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বা দুজন মানুষের একত্রে থাকার আইনগত অনুমতি নয়, এটি একটি পবিত্র ইবাদত ও মহান দায়িত্ব। হাদিস শরিফে বিয়ে সম্পর্কে এসেছে: “বিবাহ আমার সুন্নত; আর যে আমার সুন্নতকে অপছন্দ করে, সে আমার উম্মত নয়।” (বুখারি)
এই গুরুত্ব বুঝেই বলা যায়—এটি এমন কিছু নয় যা আবেগে ভেসে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া যায়, বিশেষ করে যখন পরিবার ও সমাজ এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। ইসলামে বিয়ের ক্ষেত্রে ‘ওয়ালি’ অর্থাৎ অভিভাবকের অনুমতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে।
ইসলামের দৃষ্টিতে পিতামাতা বা অভিভাবককে অগ্রাহ্য করে পালিয়ে বিয়ে করাকে কোনোভাবেই উৎসাহিত করা হয় না। বরং এটি অশোভন, সমাজবিরোধী এবং একটি পরিবারিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো কাজ হিসেবে বিবেচিত। যদিও শরিয়তের নির্দিষ্ট শর্ত (প্রাপ্তবয়স্কতা, প্রস্তাব-গ্রহণ, সাক্ষী ইত্যাদি) পূরণ হলে ওই বিয়ে শরিয়ত অনুযায়ী কার্যকর হতে পারে, তবু এটিকে সঠিকভাবে, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা না করায় এটি একটি গুনাহর কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিয়েকে অনেক সময় “ফাসিদ” বা অকার্যকর বলেও চিহ্নিত করা হয় হানাফি মাজহাবে। অন্য মাজহাবগুলোতে এটি আরও কঠোরভাবে দেখা হয়।
আমরা জীবনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তেও বাবা-মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করি—কোথায় পড়ব, কী পড়ব, কোথায় চাকরি করব—সবকিছুতেই অভিভাবকের ভূমিকা থাকে। তাহলে জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যেটি পুরো জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে, সেটি নিতে গিয়ে অভিভাবকের মতামত অগ্রাহ্য করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
অভিভাবক মানেই কেবল বাধা দেওয়া নয়। বরং তারা তাদের সন্তানের কল্যাণের দিকেই নজর রাখেন। হয়তো অনেক সময় তাঁদের সিদ্ধান্ত বা বিলম্ব আমাদের কাছে অনুচিত মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের অভিজ্ঞতা, দূরদৃষ্টি এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার চিন্তাই সন্তানদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।
সমাজে অনেকেই প্রেম-ভালোবাসার নামে হারাম সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং একসময় তা বৈধ করার জন্য বিয়ের আশ্রয় নেয়। এতে তারা হয়ত সামাজিকভাবে নিজেদের রক্ষা করে, কিন্তু আল্লাহর বিধানের চোখে তারা হারাম সম্পর্কের সূচনা করেছে, এবং তা থেকে বাঁচার জন্য তড়িঘড়ি করে আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নিয়েছে—যা আরো বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এটা পরিষ্কার যে, ইসলাম আগে থেকেই নারী-পুরুষের অপ্রয়োজনীয় মেলামেশাকে সীমিত করে দিয়েছে। পর্দার বিধান, মিশ্রণের নিষেধাজ্ঞা, নন-মাহরামদের থেকে দূরে থাকার নির্দেশ—all are part of a system designed to prevent falling into haram in the first place.
বিয়ে নিয়ে জটিলতা, পারিবারিক অনিচ্ছা, সংস্কারগত দ্বন্দ্ব—এসব কিছুর মাঝেও ইসলাম শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক সমাধানের দিকনির্দেশনা দেয়। একজন সন্তান যদি দেখে পিতা-মাতা অবিচার করছেন বা অযৌক্তিকভাবে বিয়েতে বাধা দিচ্ছেন, তাহলে প্রথমে পারিবারিকভাবে কাউন্সেলিং, আলেমদের মধ্যস্থতা, সামাজিক সম্মানিত ব্যক্তিদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে স্থানীয় ইসলামি স্কলার বা শরিয়ত বোর্ডের হস্তক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিয়ে শরিয়তের দৃষ্টিতে শুদ্ধ হতে পারে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, তবে তা কখনোই আদর্শ বা গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে শুধু পারিবারিক অশান্তি নয়, বরং সমাজেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যা ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী।
পালিয়ে বিয়ে করা হয়তো শরীয়তের নির্দিষ্ট শর্ত পূরণে বৈধ হতে পারে, তবে এটি মহা অন্যায়, অমানবিক ও অসামাজিক কাজ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব পরিবারকে জানানো, তাঁদেরকে মানিয়ে নেওয়া এবং আল্লাহর কাছে এই গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাই হচ্ছে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তম পথ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আবেগ নয়, হিকমা ও ধৈর্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ