
ছবি: সংগৃহীত
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ পর্যায়ে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘জনতার মঞ্চ’ নামে এক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী আন্দোলন তখনকার সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সচিবালয়সহ সারাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছাড়ার আগে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেন।
প্রায় ২৮ বছর পর একই ধরনের রাজনৈতিক প্রয়াস আবারও মাঠে ফিরছে বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দা সূত্র। বিএনপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্ত করতে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধানে নতুন করে ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি বলছে, এ প্ল্যাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দেড় শতাধিক সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
মঞ্চ ৭১-এর কার্যক্রম ও গোলটেবিল আলোচনায় ঘটনা
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, গত ২৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) মঞ্চ ৭১-এর আড়ালে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় অংশ নেওয়া কয়েকজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক করা হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে মঞ্চ ৭১-এর সদস্যরা সরকারবিরোধী কার্যক্রমের ছক কষছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, জনতার মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত সাবেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে যে ফৌজদারি মামলা হয়েছিল, সেটি পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত চিঠি ইতিমধ্যেই আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং-এ পাঠানো হয়েছে। প্রস্তুত করা হয়েছে ২০৯ জনের তালিকা, যার মধ্যে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, ভূঁইয়া মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং সাবেক সচিব সিরাজ উদ্দিন আহমেদসহ আরও দেড় শতাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন।
পুলিশের প্রতিক্রিয়া
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “সরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক মঞ্চে যোগদান একেবারেই উচিত নয়। এটি প্রজাতন্ত্রের চাকরিবিধি লঙ্ঘন এবং সরকারদ্রোহের শামিল। এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের দায়িত্ব।” তিনি আরও বলেন, “জনতার মঞ্চের কর্মীরা নতুন মঞ্চেও সক্রিয় হলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি আরও শক্তিশালী হবে।”
গ্রেপ্তার ও মামলা
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ‘জনতার মঞ্চ’ মামলাটি প্রত্যাহার করলেও, বর্তমান সরকার সেই মামলা পুনরায় চালু করেছে। ইতিমধ্যেই সাবেক দুজন সচিব—আবু আলম মো. শহীদ খান এবং ভূঁইয়া মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম—কে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া, লতিফ সিদ্দিকী গত ২৮ আগস্ট ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১-এর গোলটেবিলে বক্তব্য দিতে গিয়ে মবের হাতে আটক হন।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকের মন্তব্য
জনপ্রশাসন বিশ্লেষক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, “জনতার মঞ্চ ছিল বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই সংস্কৃতি এখনও থেকে গেছে। প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া বড় ধরনের অপরাধ।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আতিফ রহমান বলেন, “মঞ্চ ৭১-এর গঠন একটি সুসংহত পরিকল্পনার অংশ। সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা, শিক্ষক এবং সাংবাদিকদের এই ধরনের মঞ্চের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব খেলার চেষ্টা, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
বর্তমান পরিস্থিতি
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মঞ্চ ৭১-এর সদস্যরা জনতার মঞ্চের প্রাক্তন কৌশল অনুসরণ করে আবার মাঠে সক্রিয় হচ্ছেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তারা নতুন রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশের চেষ্টা করছে, যা সরকারের নজরদারির আওতায় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাবধানী অবস্থানে রয়েছে এবং সম্ভাব্য সরকারবিরোধী কার্যক্রম রুখতে প্রস্তুত।
এইভাবে, ‘মঞ্চ ৭১’ শুধু সাবেক কর্মকর্তাদের নয়, পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি বলছে, সাবেকদের পুনরায় সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ