
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংক খাত ইতিমধ্যেই খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও অনিয়মের কারণে ক্রমশ অচল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো একদিকে যেখানে সাধারণ আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না, অন্যদিকে সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসব বোনাস ও ইনসেনটিভ বোনাসের নামে বছরে সর্বনিম্ন বেতনের আড়াইগুণ থেকে সর্বোচ্চ ছয়গুণ পর্যন্ত সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বছরে পাঁচ-ছয়টি পর্যন্ত বোনাস নেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এতে ব্যাংক খাতের আর্থিক শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় এখন এই বোনাস বিলাসিতায় লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন বোনাস নির্দেশিকার খসড়া তৈরি হয়েছে। অনুমোদন হলে নির্দেশিকাটি দ্রুত কার্যকর হবে বলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নতুন নির্দেশিকার কাঠামো
নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, বোনাস দেওয়ার ভিত্তি হবে নিট মুনাফা, পরিচালন মুনাফা নয়। অর্থাৎ ঋণ ও অগ্রিমের প্রভিশন, বিনিয়োগের ক্ষতি-লাভ এবং অন্যান্য সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি বাদ দিয়ে প্রকৃত মুনাফা হিসাব করতে হবে। এ থেকে প্রথমে সরকারকে লভ্যাংশ দিতে হবে, তারপর বোনাস দেওয়ার সুযোগ আসবে।
এছাড়া বোনাস নির্ধারণের জন্য পাঁচটি সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে—
১. চলতি মূলধনের ওপর নিট মুনাফার হার
২. আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধির হার
৩. ঋণ ও অগ্রিম বৃদ্ধির হার
৪. খেলাপি ঋণ আদায়ের হার
৫. অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের হার
প্রতিটি সূচকে নম্বর দেওয়া হবে, এবং অর্জিত নম্বরের ভিত্তিতে বোনাসের পরিমাণ নির্ধারণ হবে। কেউ ভালো করলে সর্বোচ্চ তিনটি বোনাস পাবে। তবে নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে ব্যর্থ হলে কোনো বোনাসই দেওয়া হবে না।
অডিট রিপোর্টে বোনাস কেলেঙ্কারির চিত্র
বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সাধারণ বিমা করপোরেশনের বহু শাখা অতিমাত্রায় বোনাস দিয়েছে। জনতা ব্যাংকের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একাধিক শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতনের তিন থেকে চারগুণ ইনসেনটিভ নিয়েছেন। সাধারণ বিমা করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে অনুমোদন ছাড়াই আড়াইগুণ উৎসব বোনাস দেওয়া হয়েছে, এতে প্রায় ১৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকও বছরে তিনটির বেশি বোনাস দিয়েছে, যদিও নিয়ম ছিল সর্বোচ্চ দুটি। এ ঘটনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ফেরত আনার নির্দেশ দিলেও এখনো তা ফেরত আসেনি।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেছেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন নির্ধারিত উৎসব বোনাসের বাইরে ইনসেনটিভের নামে একাধিক বোনাস দিয়েছে। নতুন নির্দেশিকা কার্যকর হলে এটি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। ভবিষ্যতে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই বোনাস দেওয়া হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “লোকসানে থাকা কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তারা আর বোনাস পাবেন না। ব্যাংকের মূলধন যদি ১০ শতাংশের নিচে নামে এবং প্রভিশন লস করে, তাহলে কোনো ধরনের ডিভিডেন্ড বা বোনাস বিতরণ নিষিদ্ধ থাকবে।”
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, “যেখানে ব্যাংকগুলো জনগণের আমানত ফেরত দিতে পারছে না, সেখানে বিলাসী বোনাস বিতরণ নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এটি বন্ধ না হলে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমে যাবে।”
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বীমা বিভাগের অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাব, ভুয়া ঋণ বিতরণ ও খেলাপিদের প্রতি নরম অবস্থানের কারণে ক্রমাগত মূলধন সংকটে পড়ছে। এর মধ্যেই বোনাস বিলাসিতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন, “সরকার যখন বিদেশি ঋণ ও বাজেট ঘাটতি মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মীদের ছয়গুণ পর্যন্ত বোনাস নেওয়া চরম অবিচার। এই ধরনের অনিয়ম থামাতে শক্ত পদক্ষেপ ছাড়া উপায় নেই।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বোনাসের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট হচ্ছে। এটা আসলে লুটপাটের বৈধ রূপ। নতুন নির্দেশিকা কার্যকর হলেও যদি তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হয়, তবে সমস্যার সমাধান হবে না।”
লাগাম টানার চ্যালেঞ্জ
অর্থ মন্ত্রণালয়ের খসড়া নির্দেশিকা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তবে বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। কারণ অতীতে নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়ম ভেঙে বোনাস দিয়েছে। এবার সেই সংস্কৃতি ভাঙতে হলে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “শুধু কাগজে কলমে নিয়ম বানালেই হবে না। বোনাস দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হয়, তবে এই উদ্যোগও ভেস্তে যাবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ